স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিলেন কেন।

স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিলেন কেন।
স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিলেন কেন।

৫০ বছর পর কেন এই সুখী দম্পতি স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিলেন কেন।

সুখ-দুঃখে একসঙ্গে কেটে গেছে প্রায় পাঁচ দশক। দুজনেই পানি ভালোবাসতেন, ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন। তাই জ্যান ও এলস ঘর বেঁধেছিলেন নৌকায়। থেকেছেন ক্যাম্পারভ্যানেও (গাড়িতে বসবাস)। হঠাৎই এই মাসের শুরুতে নেদারল্যান্ডসের সত্তরোর্ধ্ব এই দম্পতি স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেন। এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন বিবিসির লিন্ডা প্রেসলি।

নেদারল্যান্ডসে স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ। তবে এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। দেশটির আইনে চিকিৎসকের সাহায্যে স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য আবেদন করা যায়। চিকিৎসকেরা শারীরিক অথবা মানসিক যন্ত্রণা ‘অসহনীয় ও নিরাময় অযোগ্য’ বলে প্রমাণ পেলে স্বেচ্ছামৃত্যুতে সম্মতি দেন। দম্পতি বা যুগলেরাও এভাবে স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

২০২৩ সালে নেদারল্যান্ডসে ৯ হাজার ৬৮ জন স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছেন। এই হার দেশটির ওই বছরের মোট মৃত্যুর প্রায় ৫ শতাংশ। একই সময়ে ৩৩ যুগল একসঙ্গে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছেন।

নেদারল্যান্ডসে স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ। তবে এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। দেশটির আইনে চিকিৎসকের সাহায্যে স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য আবেদন করা যায়। চিকিৎসকেরা শারীরিক অথবা মানসিক যন্ত্রণা ‘অসহনীয় ও নিরাময় অযোগ্য’ বলে প্রমাণ পেলে স্বেচ্ছামৃত্যুতে সম্মতি দেন। দম্পতি বা যুগলেরাও এভাবে স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

৩ জুন স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ করেন জ্যান ও এলস দম্পতি। তার তিন দিন আগে এই দম্পতির সঙ্গে দেখা করেন বিবিসির সাংবাদিক লিন্ডা প্রেসলি। নেদারল্যান্ডসের ফ্রাইসল্যান্ডে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে নিজেদের ক্যাম্পারভ্যানে বসে জ্যান কৌতুক করে প্রেসলিকে বলেছিলেন, ‘আমরা মাঝেমধ্যে পাথরের কাঠামোর নিচে, মানে একটি বাড়িতে বসবাস করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।’

ইটপাথরের বাড়িতে বসবাস না করে বিবাহিত জীবনের বেশির ভাগটাই ভ্রাম্যমাণ জীবন কাটিয়েছেন এই দম্পতি। কখনো ক্যাম্পারভ্যানে, কখনো হাউস বোটে।

‘আমরা মাঝেমধ্যে পাথরের কাঠামোর নিচে, মানে একটি বাড়িতে বসবাস করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।’
জ্যান

৭০ বছরের জ্যান বেশ কয়েক বছর ধরে মেরুদণ্ডে মারাত্মক ব্যথায় (ব্যাক পেইন) ভুগছেন। আর ৭১ বছর বয়সী এলস ভুগছিলেন ডিমেনশিয়ায়।

সেদিন দুজনের প্রথম দেখার গল্প শুনিয়েছিলেন এলস ও জ্যান। জানিয়েছিলেন, তাঁদের প্রথম দেখা হয় কিন্ডারগার্টেনে। এরপর তাঁরা বিয়ে করেন। অল্প বয়সে জ্যান নেদারল্যান্ডসের যুবদলের হয়ে হকি খেলেছেন। তারপর তিনি হকি কোচিং শুরু করেন। এলস প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন

দুজনেরই পানি ও নৌকার প্রতি ভালোবাসা ছিল। যে কারণে দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই তাঁরা হাউস বোটে বসবাস শুরু করেন। পরে তাঁরা একটি কার্গো বোট কেনেন এবং দেশজুড়ে পানিপথে পণ্য পরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন। এরই মধ্যে এলসের কোলজুড়ে আসে একমাত্র ছেলে। ছেলে সারা সপ্তাহ স্কুলে থাকত। সপ্তাহ শেষে মা-বাবার সঙ্গে হাউস বোটে কাটাত। ছুটির দিনগুলোতে যখন ছেলে হাউস বোটে থাকত, তখন এই দম্পতি বিভিন্ন জায়গায় পণ্য পরিবহনের অর্ডার নিতেন। কাজের সূত্র ধরে ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেই এমনটা করতেন তাঁরা।

ইটপাথরের বাড়িতে বসবাস না করে বিবাহিত জীবনের বেশির ভাগটাই ভ্রাম্যমাণ জীবন কাটিয়েছেন এই দম্পতি। কখনো ক্যাম্পারভ্যানে, কখনো হাউস বোটে।

সবকিছু ভালোই চলছিল। ১৯৯৯ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে পণ্য পরিবহন ব্যবসা বেশ প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক দশকের বেশি সময় ধরে দিন-রাত পরিশ্রম করার কারণে জ্যান অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর মেরুদণ্ডে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। তিনি ও এলস নৌকা ছেড়ে বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু কয়েক বছর পর তাঁরা আবার তাঁদের ভাসমান জীবনে ফিরে যান। তবে নৌকায় বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁরা ক্যাম্পারভ্যান কেনেন।

২০০৩ সালে জ্যানের মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু তাতে অবস্থার উন্নতি হয়নি। তাঁকে অনেক ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে হয়। আর কাজকর্মও করতে পারছিলেন না। এলস তখনো তাঁর শিক্ষকতা জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তখন তাঁরা মাঝেমধ্যে স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে কথা বলতেন। জ্যান তাঁর পরিবারকে বলেছিলেন, শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে তিনি আর বেঁচে থাকতে চান না। সে সময় তাঁরা দ্য নেদারল্যান্ডস ‘রাইট টু ডাই’ অর্গানাইজেশনে যোগ দেন।

‘যদি আপনাকে অনেক ওষুধ খেতে হয়, জীবন তখন জোম্বির মতো হয়ে যায়। তাই আমার এই ব্যথা ও এলসের অসুস্থতা, আমার মনে হয়েছে, আমাদের এসব থামাতে হবে।’
জ্যান

২০১৮ সালে এলস অবসরে যান। তাঁর মধ্যে ডিমেনশিয়ার (স্মৃতিলোপ) প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। কিন্তু তিনি চিকিৎসকের কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এলসের বাবা আলঝেইমারে আক্রান্ত ছিলেন এবং এলস প্রতিদিন একটু একটু করে তাঁর হারিয়ে যাওয়া ও মৃত্যু নিজের চোখে দেখেছেন। এ কারণেই হয়তো এলস চিকিৎসকের কাছে যেতে চাইতেন না।

জ্যান বলেন, ‘যদি আপনাকে অনেক ওষুধ খেতে হয়, জীবন তখন জোম্বির মতো হয়ে যায়। তাই আমার এই ব্যথা এবং এলসের অসুস্থতা, আমার মনে হয়েছে, আমাদের এসব থামাতে হবে।’ এই থামানোর অর্থ জীবন শেষ করে দেওয়া।

২০২২ সালের নভেম্বরে চিকিৎসকের পরীক্ষার ফলাফলে এলসের ডিমেনশিয়া শনাক্ত হয়। সেদিন স্বামী ও ছেলেকে পেছনে ফেলে সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এলস।

এলস যখন জানতে পারলেন, চিকিৎসায় তাঁর অবস্থার আর উন্নতি হবে না। তখন তিনি ও জ্যান তাঁদের ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে কথা বলা শুরু করেন।

তবে একসঙ্গে স্বেচ্ছামৃত্যুর বেলায় সঙ্গীর একজন যদি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন এবং স্বেচ্ছামৃত্যুতে নিজের সম্মতি দিতে অক্ষম হন, সে ক্ষেত্রে জটিলতার তৈরি হয়। অনেক চিকিৎসক এ ক্ষেত্রে রাজি হন না। এ ছাড়া যখন কোনো যুগল একসঙ্গে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করতে চান, তখন একজন আরেকজনকে প্রভাবিত করছেন কি না, সেটাই চিকিৎসকদের যাচাই করে নিতে হয়।

জ্যান ও এলস দম্পতির বেলাতেও চিকিৎসকেরা আপত্তি জানান। এরপর তাঁরা ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র ‘দ্য সেন্টার ফর এক্সপার্টস অন ইউথানেশিয়াতে’ যান। গত বছর নেদার‍ল্যান্ডসে যে কয়জন স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশের চিকিৎসা এই ক্লিনিকের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। ওই চিকিৎসাকেন্দ্রে এলসকে দুজন চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন। চিকিৎসকেরা দেখেন, এলসের ডিমেনশিয়া এখনো এমন পর্যায়ে রয়েছে যে তিনি স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন।

‘শেষ আধঘণ্টা কঠিন ছিল। চিকিৎসকেরা এলেন এবং সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে গেল। তাঁরা তাঁদের রুটিন অনুযায়ী সব করলেন এবং তারপরতো মাত্র কয়েক মিনিটের বিষয়।’
জ্যান ও প্রিসিলার ছেলে

স্বেচ্ছামৃত্যুর কারণ হিসেবে জ্যান বলেন, ‘আমি আমরা জীবন উপভোগ করেছি। রোগের এই যন্ত্রণা আর সহ্য করতে চাই না। এখন আমাদের থেমে যাওয়ার সময়।’

স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে ছেলের ভাবনার কথাও জানান জ্যান। বলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই আপনার মা-বাবাকে মরে যেতে দিতে চাইবেন না। তাই চোখে পানি আসবেই।’ তিনি বলেন, ছেলে তাঁদের ভালো সময়ের আশার কথা বলেছে। কিন্তু জ্যান ও এলস বুঝে গেছেন, ভালো সময় আর তাঁদের জন্য নয়।

জ্যান ও এলসের স্বেচ্ছামৃত্যুর দিন নির্ধারিত হয়। ঠিক তার আগের দিনটিতে দুজন, ছেলে ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটান। সৈকতে হাঁটতে যান। মজা করেন।
জ্যান ও এলসের ছেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সেই দিনটি খুবই অদ্ভুত ছিল। বলেন, ‘আমার মনে আছে, আমরা একসঙ্গে নৈশভোজ করি। আমরা সবাই এই শেষবার নৈশভোজে অংশ নিয়েছি, এটা ভেবে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল।’

৩ জুন সকালে সবাই স্থানীয় একটি হাসপাতালে জড়ো হন। এই দম্পতির বন্ধু এবং পরিবারের লোকজনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দুই ঘণ্টা তাঁরা একসঙ্গে সময় কাটিয়েছেন, গল্প করেছেন। তারপর চিকিৎসকেরা আসেন এবং এলস ও জ্যানকে নিয়ে যান।

ছেলে বলেন, ‘শেষ আধঘণ্টা কঠিন ছিল। চিকিৎসকেরা এলেন এবং সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে গেল। তাঁরা তাঁদের রুটিন অনুযায়ী সব করলেন এবং তারপরতো মাত্র কয়েক মিনিটের বিষয়।’

এলস-জ্যানের ক্যাম্পারভ্যানটি এখনো বিক্রি করেননি ছেলে। ঠিক করেছেন কিছুদিন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ওই ক্যাম্পারভ্যানে ঘুরে বেড়াবেন। শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পারভ্যানটি বিক্রি করতে হবে জানেন ছেলে। তবে তার আগে পরিবারের সঙ্গে কিছু স্মৃতি জমিয়ে রাখতে চান।