কয়েক মিনিটের ব্যবধানে যেভাবে দাবার বোর্ড থেকে পরপারে জিয়া
কয়েক মিনিটের ব্যবধানে যেভাবে দাবার বোর্ড থেকে পরপারে জিয়া
জাতীয় দাবার ১২তম রাউন্ড চলছে। গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদকে ফিদে মাস্টার মনন রেজা নীড় হারালে, আর দুই গ্র্যান্ডমাস্টার রাজীব-জিয়ার লড়াইয়ে জিয়া হারলে ১৪ বছর বয়সী নীড় জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হবেন। এই সমীকরণ মাথায় নিয়ে বিকেলের দিকে দাবা ফেডারেশনে উপস্থিত সবাই।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তৃতীয় তলায় ক্রীড়া রুমে খেলা চলছিল। খেলা চলাকালে অন্যদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। ফেডারেশনের প্রশাসনিক কক্ষে অথবা সাধারণ সম্পাদকের রুমে দাবার আড্ডাই ভালোই জমে। প্রশাসনিক কক্ষে ঢুঁ দিয়ে দেখা গেল জিয়ার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা, ফাহাদের বাবা, আন্তর্জাতিক বিচারক হারুনুর রশিদ, ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক মাসুদুর রহমান মল্লিক আড্ডারত। এক যুগেরও বেশি সময় ক্রীড়া সাংবাদকিতা করায় এদের সবার সঙ্গেই সখ্যতা।
আড্ডায় শামিল হওয়ার পর জানা গেল নীড় নিয়াজের সঙ্গে ড্র করেছেন, আর জিয়া-রাজীব লড়াই চলছে। আগামীকাল (শনিবার) শেষ রাউন্ডে অমিত বিক্রমকে হারালেই চ্যাম্পিয়ন নীড়। এই সমীকরণ জানার পর যখন উঠতে যাব, তখন প্রথম আলোর বিশেষ ক্রীড়া প্রতিনিধি মাসুদ আলম আসলেন। আড্ডা আরও একটু জমে উঠল।
এই প্রাণোচ্ছল আড্ডার মধ্যেই ফিদে মাস্টার নাইম ও আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিল হন্তদন্ত হয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে হাপিয়ে বলছিলেন, ‘জিয়া ভাই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।’ এটা শুনেই জিয়ার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য বলছিলেন, ‘আমার জিয়ার কি হলো? আমার জিয়াকে দেখো। জিয়ার দুই দিন জ্বর ছিল। জিয়ার হঠাৎ কি হলো!’
উপস্থিত দুই সাংবাদিকও ছুটলাম দাবা বোর্ডের রুমে। জিয়া মাটিতে লুটিয়ে আছেন। জাতীয় দাবার অন্য প্রতিযোগিরা জিয়ার মাথা ও পা ধরে আছেন। কেউ পানি ছেটালেন। কয়েক মিনিট পর একটু দীর্ঘশ্বাস নিলেন। আবার নীরব-নিস্তব্ধ। অ্যাম্বুলেন্সে কথা বলছিলেন ফেডারেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ। উপস্থিত অনেকে বললেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় লাগবে, রাজীবের (আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার) গাড়িতে দ্রুত উঠানো হোক।’
৩টায় শুরু হওয়া জাতীয় দাবার ১২তম রাউন্ড চলাকালে জিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ৫টা ৫০ মিনিটে। কালক্ষেপণ না করেই ফেডারেশনের তিনতলা থেকে সিড়ি দিয়ে নামিয়ে রাজীবের গাড়িতে তোলা হয় তাকে। সেই মুহূর্তে এসে উপস্থিত হন ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক শোয়েব রিয়াজ আলম। রাজীবের গাড়ি কোথায় যাবে এ নিয়ে দুই-এক মিনিট আলোচনা। কেউ বললেন, ‘কাকরাইলে ইসলামী হাসপাতাল নিকটবর্তী সেখানে নেওয়া হোক’ আবার কেউ বললেন, ‘হৃদযন্ত্রের সমস্যা বোধহয়, শুক্রবার রাস্তা ফাঁকা ইব্রাহিম কার্ডিয়াকেই নেওয়া হোক।’
মিনিট দুয়েকের মধ্যে ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। রাজীবের গাড়িতে আন্তর্জাতিক বিচারক ও ফেডারেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারুন ছিলেন। জিয়ার স্ত্রী মিনিট দুয়েক পর রওনা হন শোয়েব রিয়াজ আলমের গাড়িতে। আমরা দুই সাংবাদিকও পিছু পিছু ছুটলাম।
আরও পড়ুন
আমরা পৌঁছানোর পরপরই দেখি জিয়ার স্ত্রী ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের জরুরি বিভাগের সামনে কাঁদছেন, ‘আমার জিয়াকে ডাকো, জিয়া ঘুমিয়ে আছে।’ আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিল তাকে ধরে বোঝাচ্ছেন। আমরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। জরুরি বিভাগে ঢুঁ দিয়ে জানলাম পালস পাচ্ছেন না চিকিৎসকরা। জিয়া সম্ভবত নেই।
রোগীর পালস পাওয়ার জন্য চিকিৎসকরা সাধারণত মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করেন। জিয়ার জন্য অপেক্ষা বিশ মিনিটেরও বেশি। এরপরও পালস ও প্রেশার কিছুই আসছে না। চিকিৎসকরা নিশ্চিত জিয়া আর নেই। তার স্ত্রী মানতে নারাজ জিয়া, ‘এভাবে যেতে পারে না।’ অন্য হাসপাতালে নিতে চান জিয়াকে। ফেডারেশনের আরও কর্মকর্তা, দাবাড়ু ও জিয়ার পরিবারের অন্য সদস্যরাও ততক্ষণে এসে উপস্থিত। চিকিৎসকের সঙ্গে সবাই আলাপ করে বুঝলেন জিয়া আসলেই আর নেই! স্ত্রী লাবণ্য মানতে রাজি নন। জিয়ার ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়া স্কুলপড়ুয়া। তিনি কাঁদলেও মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। পরিবারের অন্যরা সবাই মেনে নেওয়ার পর সাড়ে ৬টার দিকে হাসপাতাল আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্যুর পত্র লেখে। ৭টার একটু আগে দেওয়া হয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা।
৫টা ৫০ মিনিটে দাবা বোর্ডে খেলতে খেলতে চেয়ার থেকে লুটিয়ে পড়লেন। দশ মিনিটের মধ্যেই রাজীবের গাড়িতে তোলা হয়। গাড়ির চালকের তথ্যমতে, নয় মিনিটের মধ্যেই গাড়ি ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে পৌঁছায়। গাড়িতে অবস্থানরত ব্যক্তিরা বলছিলেন, ‘মৎস্যভবন পার হওয়ার পরই শরীর ঠান্ডা হতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা উল্টোদিকে গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছাই।’
চোখের পলকেই জিয়া সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। কাল রাতেই এই প্রতিবেদকের সঙ্গে জাতীয় দাবা নিয়ে কথা হয়েছিল। দাবা ও ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে কত আলাপ, কত ভাবনা এবং তথ্যের আদান-প্রদান। আকস্মিকভাবে সকল কিছুর উর্ধ্বে গেলেন জিয়া। সাংবাদিকতা পেশা বড়ই নিষ্ঠুর। জাতি যখন উল্লাসে মত্ত, তখন সাংবাদিকদের উৎসবের ফুসরত নেই। আবার যখন শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ। মোবাইল-ডেস্কটপের কী-বোর্ডে যখন আঙুল নিশ্চল, তখনও লিখতে হয় শোকবার্তা। হায়রে পেশাদারিত্ব