কিরগিস্তানে বাংলাদেশিসহ বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, সর্বশেষ যা জানা যাচ্ছে কির
কিরগিস্তানে বাংলাদেশিসহ বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, সর্বশেষ যা জানা যাচ্ছে
“এখানে এখন আমরা কেউ নিরাপদে নেই। যেখানেই ফরেন পাইতেছে, সেখানেই মারতেছে। এখানে পুলিশ আছে, কিন্তু তারা আমাদের কাউকে সাহায্য করছে না,” শনিবার বিকালে বিবিসিকে বলছিলেন কিরগিস্তানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সালমান ফারসী সিয়াম।
তিনি জানান, কিরগিস্তানের স্থানীয়রা বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি, মিশরীয় সহ সকল বিদেশি শিক্ষাথীদের ওপর শুক্রবার রাতে আক্রমণ করেছে।
এই আক্রমণে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন ও অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে শুনতে পেয়েছেন শিক্ষার্থীরা। যদিও এ বিষয়ে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি।
এসব হামলার প্রতিবাদে পাকিস্তানের কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ সমাবেশও হয়েছে।
![কিরগিস্তানের স্থানীয়রা বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানী, মিশরীয় সহ সকল বিদেশী শিক্ষাথীদের ওপর গতকাল রাতে আক্রমণ করেছে।](https://ichef.bbci.co.uk/ace/ws/640/cpsprodpb/db29/live/d9b142d0-1529-11ef-9b12-1ba8f95c4917.jpg)
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যা বলছেন
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বর্তমানে কিরগিস্তানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত সহ প্রায় ১০টি দেশের ১৫ হাজারের মতো শিক্ষার্থী আছে। তবে এর মাঝে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২০০ জনের বেশি।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের এক তৃতীয়াংশ, মানে আনুমানিক ৩০০ জন দেশটির সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও বাকী প্রায় সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।
“আমরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে নিরাপদে আছি। কিন্তু যারা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করছে, তারা নিরাপদে নাই,” বলেন মি. সিয়াম।
তিনি জানান, গতকাল রাত আটটার দিকে হামলার ঘটনাটি ঘটে। তারপর রাতভর কিরগিস্তানের রাজধানী বিশকেককের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে ঢুকে স্থানীয়রা আক্রমণ করে।
“তারা প্রাইভেট হোস্টেলগুলোতে ঢুকে ছেলে-মেয়ে কিছু ভেদাভেদ না করে সবার গায়ে হাত তুলেছে। এমনও শুনতেছি যে এখন পর্যন্ত অনেকেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মাঝে বাংলাদেশি আছে কি না, জানি না। আর ছয় জনের মতো মারা গেছে, কোন কোন দেশের তা জানি না এখনও।”
তবে “নিহতদের একজনের মুখমণ্ডল বাংলাদেশির মতো বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কনফিউজড।”
এই শিক্ষার্থী আরও জানান যে হোস্টেলের পরিবর্তে যারা বাসায় থাকছেন, তারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।
![কিরগিস্তানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থী সালমান ফারসী সিয়াম](https://ichef.bbci.co.uk/ace/ws/640/cpsprodpb/da5f/live/6b987ce0-152a-11ef-a01e-a361daaea419.jpg)
কিরগিস্তানের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন আরেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আফরিন আক্তার অনন্যা। তিনিও জানান, “গতকাল রাতে হোস্টেলে ঢুকে বিদেশিদের মারধর করে স্থানীয়রা। কী কারণে মারধর করে, তা আমরা এখনও জানি না।”
শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রশাসনের সামনেই এই মারধরের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ‘প্রশাসন এখানে নীরব’।
কিরগিস্তানে কোনও বাংলাদেশ দূতাবাস না থাকায় শিক্ষার্থীরা উজবেকিস্তানে থাকা বাংলাদেশিশী দূতাবাসে যোগাযোগ করেছে। তারা আশ্বাস দিলেও “এখন পর্যন্ত ফলস্বরূপ কিছু পাইনি” বলে জানান তারা।
কিরগিস্তানে অধ্যয়নরত সৈয়দ রাকিবুল ইসলাম নামক এক বাংলাদেশী শিক্ষার্থী বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে বলেন, “গতকাল রাতে এখানে অবস্থা ভয়াবহ ছিল। পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়রা অতর্কিত হামলা চালায়।”
“রাত আটটা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত এই হামলাটি চলে। আট শতাধিক মানুষ ভাঙচুর করেছে। যারা হোস্টেলে ছিল…বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, ছেলে-মেয়ে, সবার ওপর হামলা চালায়।''
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তারা যেন ঘর থেকে বের না হয়।
“কারণ বাইরে বের হলেই স্থানীয়দের সাথে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তবে আজকের রাতটা গতকাল রাতের মতো ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে কি না, সে নিয়ে আমরা আতঙ্কিত।”
![কিরগিস্তানে অধ্যয়নরত পাকিস্তানি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে ইসলামাবাদে](https://ichef.bbci.co.uk/ace/ws/640/cpsprodpb/1b87/live/a4f1b720-1531-11ef-a5f9-c9e97f2e93cf.jpg)
এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ কী?
কিরগিস্তানে অধ্যয়নরত একাধিক দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয়দের বিবাদের বিষয়ে বিবিসি কথা বলেছে এবং তাদের কাছে ঘটনার সূত্রপাত সম্বন্ধে জানতে চেয়েছে।
তারা প্রত্যেকেই বলেছেন যে তারা নিশ্চিত নন যে কী ঘটেছে। তবে তারা ‘শুনেছেন’ যে মিশরের কিছু নাগরিকদের সঙ্গে কিরগিস্তানের স্থানীয়দের সাথে ঝামেলা তৈরি হয়েছে এবং তারপরই এই অবস্থা।
এ সম্বন্ধে জানতে চাইলে উজবেকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, “আপনাদের মতো আমরাও একই বিষয় শুনেছি।”
মূলত, মিশরীয়দের সাথে স্থানীয়দের সাথে গণ্ডগোল হয় গত ১৩ই মে এবং সেই ঘটনার সূত্র ধরেই পরবর্তীতে স্থানীয়রা মিশরীয়দের ওপর আক্রমণ করে।
“এটি (১৩ তারিখের ঘটনা) যেহেতু ফেইসবুকের মাধ্যমে পোস্ট-টোস্টও হয়, তাই স্থানীয়দের ভেতর একপ্রকার উত্তেজনা তৈরি হয়। সেই উত্তেজনার ফলশ্রুতিতেই তারা গতকাল রাতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে,” বলেন মি. ইসলাম।
“বিশেষ করে যারা ডরমিটরিতে আছেন, তাদের ওপর,” তিনি যোগ করেন।
এই ঘটনার কারণে অনেক শিক্ষার্থীরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, কিন্তু তাদের মাঝে “বাংলাদেশি কেউ আছে, এরকম কিছু শোনা যায়নি” বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে কিরগিস্তানে এরকম ঘটনা আগে ঘটেছে কি না জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন যে এর আগে ঘটেছে কি না, সে বিষয়ে তিনি জানেন না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এবারই প্রথম এমনটা হল।
![স্থানীয়দের হামলার শিকার হওয়া কিরগিস্তানে অধ্যয়নরত এক শিক্ষার্থী।](https://ichef.bbci.co.uk/ace/ws/640/cpsprodpb/f6ba/live/f4e6f080-152a-11ef-9b12-1ba8f95c4917.jpg)
দূতাবাস কী বলছে
কিরগিস্তানে যেহেতু বাংলাদেশের কোনও দূতাবাস নেই, তাই উজবেকিস্তানে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস থেকে কিরগিস্তান সংক্রান্ত সবকিছু দেখভাল করা হয়।
উজবেকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বিবিসিকে জানিয়েছেন যে তারা ইতোমধ্যে অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
''এই ঘটনার কারণে এখন পর্যন্ত কোনও বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়েছে বা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে, এমন কোনও রিপোর্ট আমরা কারও কাছ থেকে পাইনি,” বলেন তিনি।
তবে শিক্ষার্থীদের মাঝে এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং “তারা এখনও প্যানিকড”।
মি. ইসলাম বলেন যে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কিরগিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়েছে এবং “তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।”
“তারা এটাও বলেছে যে তাদের কাছে বাংলাদেশি কোনও শিক্ষার্থী হতাহত হওয়ার রেকর্ড নাই।”
এছাড়া, কিরগিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বাংলাদেশ দূতাবাসকে বলেছে যে, কোনও শিক্ষার্থীর যদি জরুরি কোনও প্রয়োজন হয়, তাহলে তারা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করবে।
“আমরা শিক্ষার্থীদের এটাও বলেছি যে আপনারা যারা প্যানিকড থাকবেন, আপনারা যদি আপনাদের ঠিকানা আমাদের সাথে শেয়ার করেন, তাহলে সেটি আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিব। আমরা তাদেরকে অনুরোধ করবো, যাতে আপনাদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা তারা করে।”
সেইসাথে, দূতাবাসের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদেরকে আপাতত নিরাপত্তার স্বার্থে ঘরে থাকতে এবং পরিস্থিতি অবলোকন করতে বলা হয়েছে।
“যদিও ওখানে যারা আছে, তারা বলেছে যে পরিস্থিতি এখন অনেকটা শান্ত। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে— পরিস্থিতি আন্ডার কন্ট্রোল, অনেকটা স্টেবল