এমন ও দিন গেছে আম্মরা ভাত খায়নি ।
রেজোয়ানাদের বাড়ি বাগেরহাটের সদর থানার কাড়াপাড়া ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে। সংসারে মা-বাবা, চার বোন, আর দাদি। বাবা ফজর মল্লিক রিকশা চালান। সেই আয়ে ঘরভাড়া দিয়ে এত বড় সংসার চালানো কঠিন ছিল। এমন অনেক দিন গেছে যে ভাত খাননি তাঁরা। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও কোলের ছোট বোন ছাড়া বড় তিন বোনের স্কুলে যাওয়া থামেনি। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ত তারা। এরপর জীবনের তাগিদে বড় বোন ফারহানা ঢাকায় এক শিক্ষকের বাসায় তাঁর বাচ্চার খেলার সাথি হয়ে আসে। একপর্যায়ে তার জায়গায় থিতু হয় মেজ বোন রেজোয়ানা। ওই বাসার ছোট্ট দুই শিশুর দেখভাল করার পাশাপাশি সে চালিয়ে গেছে পড়াশোনাও। এবার মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছে রেজোয়ানা।
২০১৬ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক জান্নাত আরা সোহেলী ও পুলিশ কর্মকর্তা ওবায়দুল ইসলাম খানের পরিবারের সদস্য হয়ে আসে রেজোয়ানার বড় বোন ফারহানা। তখন জান্নাত আরার প্রথম সন্তান হয়। তাঁর বাড়িও বাগেরহাটে। তিনি তাঁর সন্তানের সঙ্গে থাকার জন্য একজন লোক খুঁজছিলেন। তাঁর বাবার বাড়ির গৃহকর্মী রেজোয়ানার মা সাদিয়াকে এখানে নিয়ে আসেন, যেন তাঁর একটি মেয়েকে ঢাকায় দেন।
সাদিয়া বেগম শিক্ষক জান্নাতের সঙ্গে কথা বলে সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর মেয়ে এই শিক্ষক পরিবারে গেলে ভালো থাকবেন। সিদ্ধান্ত হয়, বড় মেয়ে ফারহানা আসবে ঢাকায়। যেদিন ফারহানা চলে আসে, সেদিন গাড়িতে ওঠার সময় জান্নাতের কাছে সাদিয়ার আকুতি ছিল, ‘মেয়েকে কোনো বেতন দেওয়ার দরকার নেই, শুধু পড়ার সুযোগ দিয়েন।’
ফারহানা তখন প্রাথমিকের শিক্ষার্থী। ঢাকায় আসার পর তাকে জান্নাত পড়াতেন। ফারহানার কাজ ছিল ছোট্ট নামিরার সঙ্গে খেলা আর পড়া। বাসার অন্য কাজ করার জন্য ছিল গৃহকর্মী।
জান্নাত জানান, তাঁর বাবা বাগেরহাটে কাড়াপাড়া মাধ্যমিক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। এলাকায় তিনি বেশ গণমান্য ব্যক্তি। ফারহানা যে স্কুলে পড়তেন, সেই স্কুলের শিক্ষকদের তিনি বলে দিয়েছিলেন। তাই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষকেরা তাদের ছাড় দিয়েছিলেন। দুই বছর পর ফারহানা হাইস্কুলে উঠলে নিয়মিত পড়াশোনা করার জন্য তাকে গ্রামে পাঠানো হয়। তখন রেজোয়ানা তাঁর বাসায় আসে। সে-ও একইভাবে এখানে পড়াশোনা করত। আর পরীক্ষার সময় বাড়িতে যেত। কোনো কোনো সময় দু-তিন মাস আগে এলাকায় চলে যেত। তখন তার ছোট বোন রুখসানা আকতার এসে ঢাকায় থাকত। তারা তিন বোন পালা করে এখানে থাকত, বাচ্চাদের দেখাশোনার পাশাপাশি পড়াশোনা করত
বাগেরহাটের কাড়াপাড়া মাধ্যমিক বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার মানবিক বিভাগ থেকে মাধ্যমিক পাস করে রেজোয়ানা। জিপিএ-৪ পয়েন্ট ৩৯ পেয়েছে। এখানে কীভাবে পড়াশোনা করেছে, জানতে চাইলে সে প্রথম আলোকে বলে, খালামণির তিন ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলাধুলা করা, খাইয়ে দেওয়া ছিল তার কাজ। এর পাশাপাশি নিয়মিত পড়াশোনা করেছে সে। স্কুলের শিক্ষকেরা উপস্থিতি নিয়ে ঝামেলা করতেন না। এমনকি পরীক্ষার ফি ও প্রাইভেটের বেতনও কম নিতেন।
বড় হয়ে কী হতে চাও, এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলে, তার স্বপ্ন নার্স হবে। চাকরি করবে। সবাই চাকরি করে, এটা দেখতে তার ভালো লাগে। আর একটা ইচ্ছা আছে, তা হলো মা-বাবাকে একটা ঘর করে দেওয়ার। কারণ, রেজোয়ানাদের নিজেদের কোনো বাড়ি নেই।
রেজোয়ানার বাবা ফজর মল্লিক বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ করে রিকশা কিনেছেন। গ্রামে রিকশা চালিয়ে যে আয় হয়, তা দিয়ে কিস্তি পরিশোধের পর সাতজনের সংসার চালিয়ে আর কিছু থাকে না। তাই মাথা গোঁজার জন্য নিজেদের আর কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কখনো ভাড়া দিয়ে, কখনোবা অন্যের খালি বাড়িতে থাকেন তাঁরা।
জান্নাত আর সোহেলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আগ্রহে যে এই তিন বোন পড়েছে, এমনটা নয়। পড়াশোনার এই বীজটা ওদের মধ্যে ওদের মা বুনে দিয়েছেন। আমি শুধু এগিয়ে দিয়েছি। কারণ, ওদের মধ্যে পড়াশোনার আগ্রহ ছিল। ঢাকায় স্কুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অসম প্রতিযোগিতা ও নিয়মিত ক্লাস করতে হবে, এসব কারণে পারিনি। এবার ঢাকাতেই রেজোয়ানাকে ভর্তির চেষ্টা করব।’
কাড়াপাড়া মাধ্যমিক বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে পাসের হার শতভাগ। ২৬ জন পরীক্ষার্থী ছিল। তাদের মধ্যে সাতজনই জিপিএ-৫ পেয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক শেখ নজরুল ইসলাম রেজোয়ানাসহ তিন বোনের বিষয়ে বলেন, তাদের আর্থিক অবস্থা অতটা ভালো না। তারপরও তাদের মধ্যে পড়াশোনার আগ্রহ ছিল। তাই তারা যাতে স্কুল থেকে ঝরে না পড়ে, সে জন্য যতটুকু পারা গেছে, সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
মেয়ের সাফল্যে মায়ের অনুভূতি জানতে চাইলে ফোনে সাদিয়া বেগম বলেন, ‘আমার আনন্দের শেষ নেই। গ্রামের মানুষও খুশি হয়েছে।’ এত টানাটানির সংসারে কারও কাছে হাত পাতেননি উল্লেখ করে এই মা বলেন, ‘নিজে পড়তে পারিনি, তা নিয়ে আফসোস ছিল। তাই মনে হয়েছে, নিজেদের যত কষ্ট হোক, মেয়েদের পড়াব।’ বাবা ফজর মল্লিকের কণ্ঠেও আনন্দ ঝরছিল। তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে জান্নাত আপা তার নিজের পরিবারের সদস্য মনে করে। আমার মেয়েরা তার সঙ্গে ঘুমায়, খায়। এমনকি তারা প্লেনে করে আমার মেয়েদের বেড়াতে নিয়ে গেছে। তারা যেই আদর করে, জামাকাপড়, পড়াশোনার খরচ সব দেয়, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।