রোহিঙ্গা সংকট: ভাসানচর থেকে দলে দলে কীভাবে ও কেন পালাচ্ছে তারা?
1.
প্রথম সময় ডেস্ক:
নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালানো শুরু করেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। এরই মধ্যে পুলিশের হাতে বেশ কয়েকজন ধরা পড়েছে আবার অনেকে কক্সাবাজার ক্যাম্পে পৌঁছে গেছে বলেও নিশ্চিত হয়েছে বিবিসি। তবে ভাসানচর থেকে কত রোহিঙ্গা পালিয়েছে - তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
নোয়াখালীর ভাসানচরে বর্তমানে সেখানে ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। কক্সবাজারের তুলনায় উন্নত বাসস্থান আর সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে। তা সত্ত্বেও ভাসানচর থেকে থেকে বেশ কিছুদিন ধরে রোহিঙ্গারা দলে দলে কক্সবাজারে পালাতে শুরু করেছে।
ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ধারণা, সেখান থেকে পালানো রোহিঙ্গার সংখ্যা কয়েকশ'র মত। গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে ১৩ সদস্যের একটি দল ভাসানচর থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে পৌঁছেছেন। পালিয়ে আসার রোহিঙ্গা নারীদের একজনের সঙ্গে কথা হয় বিবিসির।
তিনি জানান, একেবারে শুরুতে যাদের ভাসানচরে নেয়া হয়েছিল, তিনি তাদের একজন। ভাসানচর থেকে পালাতে বিপুল পরিমাণ টাকাও খরচ হয়েছে বলে জানান তিনি।
"আমাদের সাথে আমরা ১৩ জন ছিলাম। বোটওলা ধরে আসছিলাম নোয়াখালীতে। আমরা তিনজন একসাথে ৯০ হাজার টাকা দিছি।"
ভাসানচর দ্বীপে উন্নত সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও কেন পালিয়ে গেলেন - সেই প্রশ্নে ওই রোহিঙ্গা নারী জানান, পরিবার ছাড়া সেখানে থাকাটা তার ভাষায় ভীষণ কষ্টের।
"ভাসানচরে আমাদের অনেক সমস্যা। মা বাবা নাই। আমরা একা ছিলাম। আমরা অনেক কষ্টে ছিলাম সেখানে। খাওয়া দাওয়ার কষ্ট ছিল।"
তিনি জানান, "সিঙ্গেল সিঙ্গেল মেয়েরা অনেক সমস্যা। একলা একলা থাকা মেয়েদের হামলা করতে চায় ছেলেরা। অনেকের ঘরের মধ্যে তালা ভেঙে ঢুকে কাপড়-চোপড় অনেক নিয়ে গেছে
কোন রুটে, কীভাবে পালাচ্ছে তারা?
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা এবং ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, মূলত স্থানীয় মাঝ ধরা ট্রলার বা নৌযানে করেই পালানোর ঘটনা ঘটছে।
কক্সবাজারে ফেরা ওই রোহিঙ্গা নারীর বিবরণে ভাসানচর থেকে প্রথমে লুকিয়ে মাছধরা নৌকায় তারা নোয়াখালী পৌঁছান।
এরপর নোয়াখালী থেকে বাসে করে চট্টগ্রাম হয়ে তাদের গন্তব্য ছিল কক্সাবাজার।
সর্বশেষ উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ভাসানচর থেকে এই রুটে পালানোর সময় একাধিক গ্রুপ এরই মধ্যে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে।
গত সপ্তাহে নোয়াখালীতে নারী শিশুসহ ১২ সদস্যের একটি দলকে স্থানীয় জনগণ ধরে পুলিশে দেয়।
ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসার পথে অসংলগ্ন আচরণ দেখে স্থানীয় জনগণ রোহিঙ্গাদের ধরে কোম্পানিগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। বিষয়টি নিয়ে নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো: আলমগীর হোসেন বিবিসিকে জানান এরকম একাধিক ঘটনা ঘটেছে।
"ভাসানচর থেকে বোটে করে দালালের মাধ্যমে তারা চলে আসছে। তারা কক্সবাজারে উখিয়ার ক্যাম্পে ফেরত যেতে চায়। এরকম আরো দুই তিনটা ঘটনা ঘটেছে। হাতিয়াতে আরো দুইটা ঘটনা এখন এই ঘটনাটা এরকম তিনটার কথা আমার মনে পড়ে
আটক ১২ জন নারী পুরুষ ও শিশুকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার।
ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গাদের পালানোর এই প্রবণতা কতদিন ধরে দেখা যাচ্ছে এ প্রশ্নে তিনি বলেন, "এইতো কিছুদিন আগে থেকে, মাস খানেক আগে থেকে এটা দেখা যাচ্ছে। আসলে প্রথম আসার কিছুদিন পর থেকেই এটা শুরু হয়েছে।"
কেন পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা?
এদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই প্রবণতা কেন তৈরি হলো - সেটি বোঝার জন্য ভাসানচরে অবস্থানরত কয়েজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা জানান, রোহিঙ্গাদের পাচার করতে একটি দালাল চক্র তৈরি হয়ে গেছে। এরা স্থানীয় মাছ ধরা নৌকার মাঝিদের সঙ্গে যোগসাজসে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন রূটে পালাতে সহায়তা করছে।
তিনি বলেন, মালয়েশিয়া যাবার পথে উদ্ধার করে যাদের প্রথম ভাসানচরে নেয়া হয়, তাদের মাধ্যমেই এই প্রবণতা শুরু।
"আমার ধারণা এ পর্যন্ত চার থেকে ৫শর মতো হবে আনুমানিক। বেশিরভাগ পালাইছে মালয়েশিয়ার গ্রুপ। ওদের দিয়ে পালানোর উদ্বোধন হইছে," বলেন ওই রোহিঙ্গা।
তিনি বলেন, "ওদের যখন আমাদের মধ্যে ছেড়ে দিছে- ওদের মা বাবারা, স্বামীরা সন্দীপ নোয়াখালী দিয়ে ট্রলার পাঠিয়ে নিয়ে গেছে। আর কিছু ব্যাচেলর আছে ওরা পালাইছে।"
ভাসানচরের বসবাসরত এই রোহিঙ্গা নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম পরিচয় গোপন রেখেছেন।
ওই ব্যক্তি তুলে ধরেছেন, কক্সাবাজারের চেয়ে উন্নত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্বেও রোহিঙ্গারা কেন পালাচ্ছেন।
তার কথায়, ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা অংশ আয় রোজগার কমে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন।
এছাড়া অনেকে মা-বাবা পরিবার-পরিজন কক্সবাজারে থাকার কারণে তারা সেখানে ফিরে যেতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
একটা শ্রেণী আছে যারা দ্বীপের মধ্যে মানসিকভাবে নিজেদের বন্দী বলে মনে করছেন
"আমাকে এক লাখ টাকা দিলেও আমি পালাবো না। কিন্তু কিছু লোক এখানে কক্সবাজার থেকে এসেছে বিশৃঙ্খলা করার জন্য। চার মাস হয়ে গেছে বসে আছে। হাতে কোনো টাকা নাই। ইনকাম নাই। চার দোকানে গিয়ে নাস্তা করতে পারে না। প্রয়োজন মতো কিছু কিনতে পারে না।"
"কিছু সিঙ্গেল ব্যাচেলর লোক আছে, মা বাবা ছাড়া আসছে। কতগুলো স্বামী থেকে গেছে, বউ চলে আসছে। কিছু বেকার ছেলে আছে, পড়াশোনা জানা কোনো কাজ পাচ্ছে না। কবে হবে, কবে সুযোগ আসবে - এটা বলে বলে আর সহ্য করতে পারছে না। এরকম মন-মানসিকতা নিয়ে চলে যাবার কথা বলতেছে"।
ভাসানচরে নবগঠিত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সেখানে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললে তারাও রোহিঙ্গাদের পালানোর বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
তবে এ পর্যন্ত কত সংখ্যক রোহিঙ্গা পালিয়েছেন সেটি সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি।
অনানুষ্ঠানিকভাবে এই প্রবণতা সম্পর্কে কর্মকর্তারা দাবি করেন, রোহিঙ্গারা লুকিয়ে যেভাবে যাচ্ছে আবার নিজেরা কেউ কেউ ফিরেও আসছে। এই আসা যাওয়ার চলছে বেশ কিছুদিন।
তবে ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাবার বিষয়টি কীভাবে ঠেকানো যায় - সেটি নিয়েও প্রশাসন বেশ তৎপর হয়েছে বলেই জানা যাচ্ছে।
ভাসানচরে এ বিষয়ে সম্প্রতি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে।
রোহিঙ্গারা যেন পালাতে না পারে, সেজন্য নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভাসানচরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা