বাংলাদেশের। সহিংসতায় রক্তাক্ত ঢাকা
ফয়সল মাহামুদ সান
সহিংসতায় রক্তাক্ত ঢাকা
কোটা সংস্কার ইস্যুতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশ ও সরকারদলীয় কর্মীদের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা জুড়ে। বৃহস্পতিবার ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষে অন্তত ১৩ জন নিহত ও পাঁচ শতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল জুড়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, পুলিশ, সাধারণ পথচারী-সহ অনেকেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে উত্তরা, মিরপুর, রামপুরা, বাড্ডা, মহাখালী, বাসাবো, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ী, বাসাবোসহ বিভিন্ন এলাকায়।
রাজধানীর রামপুরায় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনে আগুন দিয়ে ও হামলা চালিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। সন্ধ্যায় সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায় বিটিভির
সংঘাত সহিংসতার সময় রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ বক্সে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে।
সকাল থেকে এই সংঘর্ষে কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা শহর।
মহাখালী ও নাখালপাড়ায় রেলপথ অবরোধের কারণে দুপুর থেকে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
উত্তরা-আজমপুরে নিহত
‘শাটডাউন’ কর্মসূচির পক্ষে বৃহস্পতিবার সকালে উত্তরার জমজম টাওয়ারের সামনে জড়ো হন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
এতে অংশ নেয় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে সকাল এগারোটার দিকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে মূল সড়কে উঠলে পুলিশ ও র্যাবের সংঘর্ষ বাধে।
শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশ টিয়ারশেল ছুড়লে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল। পরে এই সংঘর্ষ মূল সড়ক থেকে ছড়িয়ে পড়ে অলিগলিতেও।
এই সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন। তাদেরকে ভর্তি করা হয় উত্তরার কুয়েত মৈত্রী, আধুনিক মেডেকেল কলেজ ও ক্রিসেন্ট হাসপাতালে।
এসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিবিসি বাংলাকে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে। তবে নিহতদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত করতে পারেননি তারা।
বিকেলে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা ঘেরাও করেন আন্দোলনকারীরা। কয়েক হাজার আন্দোলনকারী সেখানে অবস্থান নেন।
বিটিভি কার্যালয়ে আগুন, বাড্ডা-রামপুরা রণক্ষেত্র
সকাল এগারোটার পরপর রামপুরা ব্রিজ এলাকায় আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বনশ্রী আইডিয়াল কলেজ-সহ বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় রামপুরা ব্রিজ এলাকায়।
এসময় তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে ও লাঠিচার্জ চালায়। শুরু হয় শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষ। অনেকেই আহত হন এ ঘটনায়।
এরপর বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর হামলা চালালে সেখান থেকে পিছু হটে পুলিশ।
পরে রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন কার্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় ও কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
রামপুরা ট্রাফিক পুলিশ বক্সের অন্তত ১০টি মোটর সাইকেল আগুনে পুড়তে দেখেছেন বিবিসি সংবাদদাতা।
এই সংঘর্ষে আফতাবনগরের ইম্পেরিয়াল কলেজের ছাত্র জিল্লুর শেখের মৃত্যু হয়। একই এলাকায় দুলাল মাতবর নামের একজন গাড়ি চালকও নিহত হন।
একই সময় মেরুল বাড্ডা এলাকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
এসময় অন্তত ৬০ পুলিশ মেরুল বাড্ডার কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আটকা পড়লে, সেখানকার ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে তাদের উদ্ধার করা হয়।
যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া
কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকার মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়ায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিলে পুলিশের সাথে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন।
বিবিসির সংবাদদাতা ওই এলাকাগুলো সরেজমিনে ঘুরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখতে পেয়েছেন।
বৃহস্পতিবার বেলা একটার দিকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর ও এর আশেপাশে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে।
এসময় শিক্ষার্থীরা ব্যানার হাতে কোটা সংস্কারের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। পরে পুলিশ এসে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে তারা টিকাটুলির মোড়ের দিকে সরে যায়।
এদিকে, যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়ায় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ইটপাটকেল ছোড়ে। এতে পুলিশ ও আন্দোলনকারী দুই পক্ষের অনেকে আহত হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখায় ঢাকার সাথে চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে।
রণক্ষেত্র মিরপুর, পুলিশ বক্সে আগুন
সকাল থেকে মিরপুর ১০ নম্বরসহ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ।
মিরপুর থেকে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা জানান, সকালে মিরপুর ১০ নম্বরে সমাবেশ করছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় আন্দোলরত শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের হটিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকা দখলে নেয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাঁধে।
সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সাথে সংঘর্ষের সময় পুলিশ পিছু হটলে মিরপুর ১০ নম্বরের ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা।
এর আগে সকালে মিরপুরের দারুস সালাম এলাকায় ডেল্টা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নামার চেষ্টা করলে তাদের ওপর সরকার দলীয় কর্মী সমর্থকরা হামলা চালায়।
বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা জানান, শিক্ষার্থীদের ওপর এই হামলার সময় পুলিশও সেখানে উপস্থিত ছিল।
এর কিছুক্ষণ পর মিরপুর ১২ ও কালশী এলাকায় রাস্তায় নেমে আসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
দুপুর বারোটার থেকে পুরো ইসিবি চত্ত্বরসহ মিরপুর এলাকায় পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সাথে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
এই সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সংঘর্ষ ছড়িয়েছে ধানমণ্ডি মোহাম্মদপুরেও
সকালের পর থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকায়। ধানমণ্ডিতে এই সংঘর্ষে একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
নিহত ও শিক্ষার্থীর নাম ফারহান ফাইয়াজ। তিনি ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী।
বিবিসি বাংলাকে তার ফুফু সায়েমা খান জানান, সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর মোহাম্মদপুর সিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ধানমণ্ডি থেকে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা জানান, সকাল থেকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত থাকলে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয় দুপুর ১২টার পর। একটানা বিকেল তিনটা পর্যন্ত চলে এই সংঘর্ষ।
আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট, টিয়ারসেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড় পুলিশ।
একই সময় সায়েন্সল্যাব, নীলক্ষেত, মোহাম্মদপুর এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশ ও সরকার সমর্থিত নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়।
এসময় মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক বক্সে আগুন দেয়ার খবরও পাওয়া গেছে। এই সংঘর্ষে আহতদের ভর্তি করা হয় আশপাশের হাসপাতালগুলোতে।
মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ
সকাল থেকে রাজধানীর মহাখালী এলাকার রাস্তায় নামে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা।
এসময় পুলিশের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের।
রাজধানীর মহাখালী থেকে গণমাধ্যমকর্মী মাসুদুল হক বিবিসি বাংলার কাছে কিছু ধারণকৃত ভিডিও পাঠান।
যাতে দেখা যায়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে এই আন্দোলনে যোগ দেয় স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাদের অনেককে লাঠিসহ রাস্তায় অবস্থান করতে দেখা যায়।
ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষুদ্ধ অবরোধকারীরা এসময় রাস্তায় আগুন ধরিয় বিক্ষোভ করতে থাকে।
এর কিছুক্ষণ পর মহাখালী এলাকায় রেলপথে অবস্থান নিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয় রেল যোগাযোগ।
রেল যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন।
মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সামনে বিকেল পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের অবস্থান থাকলেও পুলিশের উপস্থিতি ছিল না।
এছাড়াও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে দিনভর সংঘাত ও ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে