বাংলাদেশে অনলাইনে সুদের ব্যবসা রমরমা, বন্ধের উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউ!
অনলাইনে সুদের ব্যবসা রমরমা, বন্ধের উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউ!
ঢাকা: দেশে অনলাইনে সুদের রমরমা ব্যবসা চলছে। র্যাপিড ক্যাশ, ক্যাশম্যান ও ক্যাশক্যাশসহ বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়ে আকৃষ্ট করছে গ্রাহকদের। আর তাদের জামানত ছাড়াই ঋণ দেওয়ার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিচ্ছেন স্বল্প আয়ের মানুষসহ তরুণরা। এরপর এসব অ্যাপ বা প্রতিষ্ঠান সুদ ছাড়াও সার্ভিস চার্জের নামে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছে বাড়তি অর্থ। তবে কোনো ধরনের অনুমোদন না নিয়েই অনলাইনে চলমান এই সুদের ব্যবসা বা এসব অ্যাপস বন্ধে উদ্যোগ নিচ্ছে কেউ। এমনকি এ বিষয়ে তেমন করণীয় নেই বলে দায় এড়িয়ে চলছে দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটিও অনলাইনে সুদের ব্যবসার দায় নিতে চাচ্ছে না। অনলাইনে সুদের ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকটি চক্রকে গ্রেফতার করা হলেও এসব অ্যাপ বন্ধে উদ্যোগ নেই পুলিশেরও। আর দেশের ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও (বিটিআরসি) এখন পর্যন্ত এসব অ্যাপস বন্ধে উদ্যোগ নেয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উল্টো গ্রাহকদেরই সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনলাইনে ঋণের ফাঁদ পেতেছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। ভার্চুয়াল মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে নানা ধরনের প্রলোভন দেখাচ্ছে। র্যাপিড ক্যাশ, টাকলা, ক্যাশম্যান, কুইক অনলাইন ই-লোন অ্যাপ, আমার ক্যাশ, ক্যাশ ক্যাশ, এসম্যানেজার ও ইনস্ট্যান্ট স্যালারি ডটকমসহ নানা অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ঋণের একটি অংশ সার্ভিস চার্জের নামে কেটে রাখা হয়। আবার মোটা অঙ্কের সুদসহ পরিশোধ করতে মূল টাকা। চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দেখেই প্রতারিত হন গ্রাহকেরা। মূলত ছাত্র-ছাত্রীসহ তরুণ প্রজন্মই জামানতবিহীন অনলাইনের ঋণের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন।
পুলিশ বলছে, ক্ষুদ্রঋণের নামে অন্তত ১০টি বিদেশি অ্যাপ দেশে অবৈধভাবে সুদের ব্যবসা করছে। অ্যাপগুলো পরিচালিত হচ্ছে চীন থেকে। অ্যাপগুলোর কার্যালয় দেশে থাকলেও অন্য প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে কার্যালয় ভাড়া নেওয়া হয়েছে। অনলাইনের সুদের এই ব্যবসায় প্রতারিত হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ, চাকরিপ্রার্থী ও ছাত্রছাত্রী। সম্প্রতি অ্যাপসভিত্তিক ডিজিটাল মাইক্রোফাইন্যান্সের নামে অবৈধ সুদের ব্যবসা করা প্রতারক চক্রের দুই চীনা নাগরিকসহ সাত সদস্যকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সারবাংলাকে বলেন, ‘অনলাইনে কেউ যদি সুদের ব্যবসা করে, সেটার নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে নেই। যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন নিয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে আছে। কিন্তু সারাদেশে যারা সুদের ব্যবসা করছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ আমাদের কাছে নেই। যারা এসব সুদের ফাঁদে পা দেবে, সেই দায়িত্বও কিন্তু ওই ব্যক্তির ওপরই বর্তাবে। কারণ তারা একজন গ্রাহকের সব তথ্য নিয়ে নিচ্ছে। ২০ হাজার টাকা নিতে চাইলে দিচ্ছে ১৬ হাজার টাকা। আবার ওই ঋণের জন্য গ্রাহককে আরও অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে গ্রাহককেই সচেতন হতে হবে।’
সারাবাংলার এক প্রশ্নের উত্তরে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু ব্যবসা আছে যা নিয়ন্ত্রণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন নয়, বাংলাদেশ ব্যাংক তাই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এদের অনুমোদন নেই। অনুমোদন থাকলে এরা এমন সাহস দেখাতে পারত না। গ্রাহককে আমরা সচেতন করতে পারি, কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধে আমরা উদ্যোগ নিতে পারি না।’
দেশে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান ফসিউল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ঋণ পরিচালনা করলে আমাদের অনুমোদন নিতে হবে। তাদের লাইসেন্স থাকতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া করলে সেটি বেআইনি। আমরা জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে বলেছি, আমাদের তালিকার প্রতিষ্ঠানগুলো বৈধ। এর বাইরে যারা ঋণ দিচ্ছে তারা অবৈধ। ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ডিসিদের বলা হয়েছে।’ তবে অনলাইনে যারা ঋণের ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কি না, সেটি সুস্পষ্টভাবে জানাতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান।
সারাবাংলার এক প্রশ্নের উত্তরে ফসিউল্লাহ বলেন, ‘অনলাইনে যারা ঋণের ব্যবসা করছে তাদের মডিউল আমার জানা নেই। তাদের কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেনের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক দেখে থাকে। যারা অবৈধভাবে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা ডিসিদের চিঠি দিয়েছি।’
জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ সারাবাংলাকে জানান, অনলাইনে সুদের ব্যবসার বিষয়টি তাদের নজরে আসেনি। বিষয়টি কে নিয়ন্ত্রণ করবে, তার সুস্পষ্ট উত্তরও দিতে পারেননি তিনি। এ বিষয়ে জানতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারকে একাধিক বার কল দেওয়া হলেও তিনি তা ধরেননি।
অবৈধ বা অনৈতিকভাবে অনলাইনে পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠানের লিংক, ওয়েবসাইট ও অ্যাপস বন্ধ করে থাকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বিটিআরসিকে চিঠি দিতে হয়। অনলাইনে সুদের এই কার্যক্রম বা এসব অ্যাপ বন্ধে বিটিআরসিকে এখনো চিঠি দেয়নি আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট কেউ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসির ভাইস-চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার রায় মৈত্র সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি (অনলাইনে সুদের ব্যবসা) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ। তারা হয়তো কাজ করছে। এসব লিংক বা অ্যাপ বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো সংস্থা আমাদের অনুরোধ জানায়নি।’
অনলাইনে সুদের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনলাইনে সুদের ব্যবসা করছে এমন কয়েকটি চক্রকে আমরা গ্রেফতার করেছি। চীনা নাগরিকসহ একটি টিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেউ যদি অভিযোগ জানায়, প্রতারিত হয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ করে, তবে আমরা অভিযান পরিচালনা করে থাকি।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, এসব প্রতিষ্ঠান বা সাইট বন্ধের উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা অর্থ মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে। কেউ প্রতারিত হলে, কেউ অভিযোগ দিলেই কেবল ওইসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে, যা পুলিশ এখনো করে যাচ্ছে বলে জানান ডিসি ফারুক হোসেন।
সামগ্রিক বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনলাইনে সুদের ব্যবসা হলে, অনুমোদন না থাকলে সেটা অবৈধ। আগেকার দিনে মহাজনরা সুদের ব্যবসা করত, সেটি ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। অনলাইনেই করুক বা মহাজনই করুক, সেটার দায় এড়ালে চলবে না। সুদের ব্যবসা কিংবা অর্থিক সব বিষয়ের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংক এই দায়িত্ব এড়াতে পারে না। দায়িত্ব নিয়ে তাদের এটি বন্ধ করতে হবে