দিনগুলি মোর প্রথম প্রপাত
অলংকরণ : নাহিদা নিশা
দিনগুলি মোর
প্রথম প্রপাত
মনে হচ্ছে, আম্মা আমায় একদম ভালোবাসেন না। মুনুর যেবার হাম হলো, আম্মা একটানা কাঁদতে কাঁদতে জায়নামাজে রাত পার করে দিয়েছেন। আর আমার বেলায় এমন নির্বিকার!
অথচ গতকাল বিকেলেও বড়মাদের গাছ থেকে ‘কলইচ্ছা বরই’ পেড়েছি। গাছটি বেশ বড়। উঠানের একেবারে দক্ষিণে।
টুকরি ভর্তি বরই নিয়ে সাবধানে গাছ থেকে নামছি। টুপ করে এক ফোঁটা রক্ত আমার পা বেয়ে গোড়ালি হয়ে নিকানো উঠানের ওপর পড়ল, যেন এক ধারালো তীরের ফলা আমার হৃৎপিিপণ্ড ভেদ করে গেছে! নিজের বুকের ধুকপুকানি নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছি, যেন সে এখনই লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে পানি-ঢালা গর্তে বন্দি তুরুল্লা পোকার মতো।
আমার কি কোনো মারণব্যাধি হয়েছে? প্লেগ, ক্যান্সার, নাকি যক্ষ্মা? আমাকে কি দূর শহরের কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে? চিকিৎসার নাম করে ডাক্তার আমায় অজ্ঞান করে কিডনি, ফুসফুস, চোখ-কান-হাত-পা সব কেটে নিয়ে নেবে?
আমি কি রাক্ষসীজাতীয় কিছু হয়ে গেছি? রাতে কি আমি গোপনে আমার পাশে শুয়ে থাকা বোনের গলায় দাঁত বসিয়ে রক্ত খাব? আমার ওপর কি কোনো খারাপ আত্মা ভর করেছে? আমি কি তবে খামার বাড়ির বেত বনে থাকব? খারাপ আত্মাকে তাড়াতে বাতেন শাহ কবিরাজ কি আমায় চুলের মুঠি ধরে তেঁতুলের ছড়ি দিয়ে অনবরত মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলবে? ঝাড়ু কামডে নিয়ে খদিজা ফুফুর মতো আমিও কি পাটিপাতা বনে আছড়ে পড়ব?
এ যে কাউকে বলাও যাবে না! বললে যদি দেখতে চায়! না, আমি তা কোনোমতেই পারব না। হায়, রক্তক্ষরণ হতে হতে আমি বুঝি মরেই যাব! আব্দুল কুদ্দুস ভাই ছেনি হাতে দৌড়ে যাবেন বাঁশঝাড়ের জঙ্গলে; ছমির হাট কবরস্থানে দাদির কবরের পাশেই আমার জন্য খুঁড়ে রাখবেন নতুন কবর! আমার আদরের ছোট বোনেরা আমার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ‘আপু! আপু!’ বলে চিৎকার করে জ্ঞান হারাবে!
বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গেল। হায়, এখনো কেউ টের পায়নি—আমি মারা যাচ্ছি! কাল সকালে কত মানুষের ভিড় হবে এই বাড়িতে।
‘কিরে, অমন চুপসে আছিস যে! মুখটা অমন শুকনা কেন?’
আম্মা আমার কাছ ঘেঁষে বসলেন। আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম।
‘আম্মা, আমি মারা যাচ্ছি, আমাকে বাঁচান, আম্মা! আম্মাগো...’।
আম্মা স্মিত হেসে বললেন, ‘পাগল মেয়ে, মরবি কেন! মেয়েদের মা হওয়ার এই প্রথম ধাপ। এ তো খুশির খবর।’
বলেই আম্মা আমাকে চুমু খেলেন। আমি অবাক হলাম—এমন ভয়ংকর রকমের একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে অথচ আম্মাকে একটুও সিরিয়াস মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আম্মা আমায় একদম ভালোবাসেন না। মুনুর যেবার হাম হলো, আম্মা একটানা কাঁদতে কাঁদতে জায়নামাজে রাত পার করে দিয়েছেন। আর আমার বেলায় এমন নির্বিকার!
রাজ্যের দুশ্চিন্তা আর অবসাদ নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে দেখি ঢোলের মতো একটা পেট নিয়ে আমি স্কুলে যাচ্ছি। আমার পেটে বাচ্চা। বই-খাতা আমার সহপাঠী সুফিয়ার হাতে। আমার হাতে আস্ত একটা বেলে তেঁতুল। কিছুক্ষণ পর পর সেই তেঁতুলে কামড় দিয়ে আমি চুকচুক করে খাচ্ছি। সুফিয়ার জিহ্বায় জল এসে যাচ্ছে, বারবার ঢোক গিলছে। আমি চোখ ঘুরিয়ে তাকালাম শুধু, অমনি সে মাথা নিচু করে ফেলল। বুঝল, পোয়াতি হওয়ার আগে তেঁতুল খেতে চাওয়া তার মোটেই উচিত হয়নি।
বাজারের কাছে যেতেই আমার ডেলিভারি পেইন শুরু হলো। ধাত্রী মাতা আতরির মা আমার পাশে বসা। আমি কেবলই আকাশের দিকে তাকাচ্ছি কোনো দুধসাদা বক আসে না কেন! অথচ আমার বোনেরা কত নিঃশব্দে পাখির পাখায় ভর করে চলে এসেছে, কেউ টেরই পায়নি। টুক করে আম্মার কোলে দিয়ে পাখিটি নিমিষে মিলিয়ে গেল!
আমার ভাবনার জাল ছিন্ন করে দেয় আতরির মার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ—‘বড়কাকী, অস্ত্রপাচার করতে হবে!’ অমনি বাজারের কার্তিক কামার তার জলধার দেওয়া চকচকা কিরিচ নিয়ে হাজির! কিরিচটা আমার পেটের উপর রাখল সে। বিকট চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি আমার বোনেরা আমাকে ঘিরে বসে আছে। আম্মা আমার পাশে শুয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আম্মা, হাসু ভাইয়ের বউয়ের অস্ত্রপাচার কি কার্তিক কামারই করেছিল?’
আম্মা শিশুদের মতো কলকল করে হেসে উঠলেন।
এত বছর পরও আমি আম্মার সেই কলকল হাসির শব্দ শুনতে পাই। চোখ বুজলেই দেখি তাঁর ঠোঁট দুটি পানের রসে রক্তরাঙা। আর দেখি আমার শৈশবের সেই রঙিন মাঠে বেড়ে উঠছে আমারই কিশোরী মেয়েটি—উচ্ছ্বল