দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, বিএনপি তাতে অংশগ্রহণ করেনি।
নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশে একটি নতুন ধারা লক্ষ করেছি আমরা। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মোটামুটি ঘোষিত, আইনসিদ্ধ এবং কার্যত একটি একদলীয় শাসন চালু হলো। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার যে বাকশাল কায়েম করেছিলেন সেটাকেই এবার তারা একটি কার্যকর রূপ দিল, চতুর্থ মেয়াদের ক্ষমতায়। এবারে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এটাকে আমি কোনোভাবেই নির্বাচন বলতে রাজি নই। নির্বাচন হয়নি বরং হয়েছে আসন ভাগাভাগির একটি খেলা। এ আসন ভাগাভাগির খেলায় আওয়ামী লীগ ২২৪টি আসন পেয়েছে আর ৬২ আসন পেয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ৫৯ জন আবার আওয়ামী লীগের পদধারী। জাতীয় পার্টি যে ১১টি আসন পেয়েছে, সেটা সমঝোতার ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টিরই বেশ কিছু প্রার্থী বলেছেন, যে যেখানে জিতবে বলে সরকার চেয়েছে, সে সেখানে জিতেছে। যাদের সরকার চায়নি তারা জিততে পারেনি। সুতরাং যে নির্বাচনে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, যেখানে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, যেখানে সবকিছুই আগে থেকে ঠিক করা সেটাকে কোনোভাবেই নির্বাচন বলা যায় না। তবে এটা সত্য যে, এমন একটা ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে গেছে। একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, নির্বাচনের আগে বিএনপির নানা ধরনের কর্মসূচি ও দাবিদাওয়া থাকলেও বিএনপি সেটা আদায় করতে পারেনি। কেন পারেনি সেই উত্তরও আমি দিচ্ছি। ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই আন্দোলন ২০১৮ সালেও জারি ছিল; কিন্তু ২০১৪-১৮ কিংবা ২০২৪ সালের নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে এ সময়গুলোতে বিএনপিকে একটি অসম লড়াই লড়তে হয়েছে। বিএনপিকে যদি শুধু আওয়ামী লীগ দলটিকে রাজনীতির মাঠে মোকাবিলা করতে হতো, তাহলে আমি বিশ্বাস করি বিএনপির জন্য এটা কঠিন কিছুই ছিল না। বিএনপিকে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে, সেই দলীয়করণকৃত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিএনপিকে একা লড়াই করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচনের কাজে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে এমনকি বিচার বিভাগকেও। সুতরাং বিএনপির জন্য এ লড়াইটা হয়ে গেছে অসম এবং অনেক বেশি কঠিন। আন্তর্জাতিক কমিউনিটির কথা যদি আমরা বলি সেখানেও তারা তাদের স্বার্থ দেখবে, সেটাই স্বাভাবিক। তারা চাইবে বাংলাদেশের মতো ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো দেশে একটি দুর্বল সরকার ক্ষমতায় থাকুক। তাহলে তাদের জন্য দরকষাকষি অনেক সহজ হয়। আমি যদি ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের কথা বলি তখন আওয়ামী লীগ সরকারের পায়ের নিচে কিছুটা হলেও মাটি ছিল। তাদের কথায় শক্তি ছিল। কারণ তারা নির্বাচন করে এসেছিল। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ তখন বলেছিল, তিস্তার পানি না দিলে ট্রানজিট দেব না। যদিও তিস্তার পানি আমাদের অধিকার এবং ট্রানজিট একটি স্পেশাল সুবিধা দুটিকে একসঙ্গে তুলনা করা যায় না। তারপরও এটুকু দরকষাকষি শেখ হাসিনা ২০০৮-১৪ মেয়াদে করতে পেরেছিলেন। তারপর আর সেই দরকষাকষির শক্তি শেখ হাসিনার ছিল না। ফলে আমরা দেখলাম তিস্তার পানি তো দূরেই থাক, ৫৪টি অভিন্ন নদী নিয়েও কোনোরকম কিছু হয়নি। উল্টো ফেনী নদীর পানি দিয়ে আসা হলো। এখন আমরা ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট সবই দিচ্ছি। সুতরাং আমাদের প্রতিবেশীরাসহ আন্তর্জাতিক মহল চাইবে দরকষাকষির সুবিধার্থে বাংলাদেশে একটি দুর্বল সরকার ক্ষমতায় থাকুক। সুতরাং এ সরকারের প্রতি তাদের এক ধরনের সমর্থন রয়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক। কালবেলা: বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মধ্যেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেছে। এমনকি মন্ত্রিসভাও গঠিত হয়ে গেছে।
নির্বাচন বর্জন থেকে বিএনপির অর্জন আসলে কী? রুমিন ফারহানা: বিএনপির বেশ কিছু অর্জন রয়েছে এখানে। একটা সময় ধারণা করা হতো বিএনপি এমন একটি দল যেটা ক্ষমতার বাইরে গিয়ে খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না। তবে বিএনপি প্রমাণ করেছে তারা ভেঙে পড়ার মতো দল নয়। ১৭ বছর ধরে বিএনপির ওপর ভীষণ রকমের নির্যাতন করা হয়েছে। এখনো বিএনপির নেতাকর্মীরা একইভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দেড় লাখ রাজনৈতিক মামলায় পঞ্চাশ লাখ আসামি। বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এমন কোনো নেতৃবৃন্দ নেই যারা নির্যাতনের শিকার হননি। বিএনপি দলটিকে ভাঙার বহু চেষ্টা হয়েছে, বহু প্রলোভন দেখানো হয়েছে। বিএনপি নেতাদের চাপ দেওয়া হয়েছে, ভয় দেখানো হয়েছে, মামলা দেওয়া হয়েছে এবং সাজা দেওয়া হয়েছে কিন্তু বিএনপিকে ভাঙা যায়নি। দ্বিতীয়ত, ১৭ বছর নির্যাতন সহ্য করার মধ্য দিয়ে বিএনপি মানুষের আরও বেশি ভালোবাসা পেয়েছে। মানুষ বিএনপির সঙ্গে রয়েছে এবং মানুষ বারবার বিএনপিকে তাদের সমর্থন দিয়েছে। বিএনপি একটি সমাবেশ বা কর্মসূচি দিলে শতবাধার পরও সেখানে মানুষের ঢল নেমেছে। বিএনপিকে মানুষ তার অধিকার আদায়ের শেষ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে। সুতরাং দিনশেষে মানুষ বিশ্বাস করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব যদি ধরে রাখতে হয়, যদি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বজায় রাখতে হয়, যদি মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা রক্ষা করতে হয়, তাহলে বিএনপির পতাকাতলেই এসে দাঁড়াতে হবে। আমরা মানুষের কাছ থেকে এ সমর্থন এবং ভালোবাসা পেয়েছি। তৃতীয়ত, মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। নির্বাচন কমিশন বলছে, ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে কিন্তু আমরা যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছি তারা দেখেছি ৫-৮ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। এমনকি শ্রী রাধা দত্তের মতো ব্যক্তিও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ভোট বর্জন করেছে এটাও বিএনপির একটি বিরাট সাফল্য। বিএনপির তৃণমূলের নেতারা এখনো ঘরে ফিরিতে পারছেন না। তারা বিশ্বাস করেন, একদিন আমাদের দিন আসবে, আমরা লড়াই করছি।