সারা বাংলাদেশে গ্রেপ্তার অভিযান
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভ, সংঘাত, ভাঙচুর, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে চলছে অভিযান।
অভিযান সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, যখন কোনো এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয় তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শত শত সদস্য গিয়ে এলাকাটি ঘিরে ফেলেন। ওই এলাকা থেকে কেউ যেন বের হয়ে যেতে না পারেন, এ জন্য সব পথে তাঁরা অবস্থান নেন। এরপর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশি করে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এটিকেই মূলত তাঁরা ‘ব্লক রেইড’ বলছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বলছে, আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় জড়ানো ব্যক্তিদেরকেই তারা গ্রেপ্তার করছে। তবে গ্রেপ্তারকৃতদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদের বড় অংশ বিএনপি–জামায়াত ও তাঁদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর নেতা–কর্মী। এর বাইরে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী–পেশার মানুষকেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশি সহিংসতা হয়েছে এমন এলাকায় তাঁরা জোরদার অভিযান চালাচ্ছেন। তা ছাড়া সহিংসতার মদদদাতা হিসেবে সন্দেহভাজন বিএনপি–জামায়াতের নেতাদের বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে থাকার নির্দেশনাও পেয়েছেন তাঁরা। এসব নেতাদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) লিটন কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতাকারীদের ধরতে আমদের অভিযান চলছে। প্রতিটি সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত না করা পর্যন্ত এ অভিযান চলবে।’
দেশের বিভিন্ন মহানগর, জেলা ও থানা-পুলিশ সূত্রে গত ১০ দিনে (গতকাল পর্যন্ত) ঢাকাসহ ৫৩টি মহানগর ও জেলায় ৫৫৫টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকার বাইরে নতুন ২২টি ও ঢাকায় আরও আটটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকায় এ নিয়ে মোট মামলার সংখ্যা ২০৯।
সারা দেশ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১০ দিনে (১৭-২৬ জুলাই) সারা দেশে মোট গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৬ হাজার ২৬৪ জন। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৭৬৫ জন। এই সময়ে রাজধানীতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২০৭ জন। শুধু রাজধানীতে ১০ দিনে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা অন্তত ২ হাজার ৪১৬ জন। আটককৃতদের অনেককে পুরনো মামলাতেও গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর শাহিনবাগ এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে যৌথ অভিযান চালানো হয়। এ সময় ওই এলাকার আকাশে হেলিকপ্টার উড়তে দেখেন এলাকাবাসী ও আশপাশের বাসিন্দারা। হেলিকপ্টার থেকে নিচে আলো ফেলতে দেখে অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন বলে জানিয়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ–কমিশনার (ডিসি) এইচএম আজিমুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা একেক দিন একেক এলাকায় অভিযান পরিচালনা করছি। তারই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার শাহিনবাগ এলাকায় অভিযান চালানো হয়।’ হেলিকপ্টার উড়লেও সেটি পুলিশের বিষয় ছিল না বলে জানান এই কর্মকর্তা।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায়ও ‘ব্লক রেইড’ এর খবর পাওয়া যায়। অভিযান শুরু করার আগে বিকেল পাঁচটার পর কাউকে বাইরে না থাকতে পুলিশের পক্ষে ঘোষণা করা হয়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলেই সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এ সময় ভবনের ওপর থেকে অভিযানের ভিডিও করতে গেল নিচ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপরে গুলি ছুড়েছেন— এমন একটি ভিডিও ফুটেজ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার রাজন কুমার সাহা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সহিংসতাকারীদের ধরতে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সহায়তায় আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। শুধু দুষ্কৃতকারীদেরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ অভিযানের ভিডিও করার কারণে গুলির কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন তিনি।
গ্রেপ্তার বিএনপি–জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও
গতকাল বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারদলীয় সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে হামলা চালিয়ে এখন তা আড়াল করতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষকে ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অনেককে আটকের পর আদালতে না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে বলে বিএনপি দাবি করেছে।
এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে রয়েছেন নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জহিরউদ্দিন স্বপন, আমান উল্লাহ আমান, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, রুহুল কবির রিজভী, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, রশিদুজ্জমান মিল্লাত, সুলতান সালাউদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, আমিনুল হক, নাসিরউদ্দিন আহমেদ অসীম, নিপুণ রায় চৌধুরী প্রমুখ।
জামায়াতের গ্রেপ্তার হয়েছেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, মিয়া গোলাম পরওয়ার, মোবারক হোসাইন। এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান (পার্থ), জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র এহসানুল হুদা, দন্ত চিকিৎসক সাখাওয়াত হোসেন।
এ পর্যন্ত বিএনপির প্রায় তিন হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সরকারি দলের সন্ত্রাসী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যৌথভাবে গুলি, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মাধ্যমে শত শত নিরীহ শিক্ষার্থীকে গণহারে হত্যা এবং হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আহত করেছে। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। এখন ব্লক রেইড দিয়ে দলীয় নেতা–কর্মী ও শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
নুরুল হককে নির্যাতনের অভিযোগ
বনানীর সেতু ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হককে আদালতে হাজির করে পুলিশ। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। শুনানির সময় আইনজীবীরা আদালতের কাছে অভিযোগ করেন, রিমান্ডে নিয়ে নুরুলকে নির্যাতন করা হয়েছে। পরে নুরুল হকের স্ত্রী মারিয়া আক্তার সাংবাদিকদের কাছে একই অভিযোগ করেন।
গ্রেপ্তার অভিযান ও ‘ব্লক রেইডের’ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ–কমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সহিংসতার ঘটনার ভিডিও ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এলাকাভিত্তিক ‘ব্লক রেইড’ চলছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সহযোগী ফোর্স হিসেবে মাঠে আছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। অভিযানের সময় হেলিকপ্টারের ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, অভিযানে সহযোগিতার জন্য র্যাব হেলিকপ্টার উড়িয়েছে।
চট্টগ্রামে অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার
চট্টগ্রামে অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থীকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংস ঘটনার মামলায় গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে। ১৬ থেকে ২৩ জুলাইয়ের মধ্যে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের দুজন, সিটি কলেজের একজন, চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ১৪ জন এবং বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদ্রাসার ১৩ জন রয়েছেন।
অনেকের নাম মামলার এজাহারে না থাকলেও সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তবে পুলিশ বলছে, ফুটেজ ও বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের স্বজনদের দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনে নাশকতার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ।
এ ছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষ, নিহতের ঘটনায় চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় ২৯টি মামলায় গত বৃহস্পতিবার রাতে আরও ৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করা