বাংলাদেশে নারীকে কেন অতিমানবী হতে হবে
সিমোন দা বোভোয়ার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য সেকেন্ড সেক্স -এর ভূমিকার একাংশে বলেছিলেন, ‘নারীর নিকৃষ্টতা প্রমাণের জন্য নারীর ক্ষমতায়নের বিপক্ষ শক্তি ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, এমনকি কৌশল পরিবর্তনও করে। ধর্ম, দর্শন কিংবা ধর্মতত্ত্বের দোহাই দিয়ে যদি নারীকে আটকে রাখা সম্ভব না হয়, তখন বিজ্ঞানের সাহায্য পর্যন্ত নেওয়া হয়।’
ইদানীং নারীর সমতা প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছে সরকারি-বেসরকারি অনেক সংগঠন। বিষয়টির দৃশ্যমান উপস্থাপনও কোনো কোনো ক্ষেত্রে জরুরি হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো, এমনকি তুলনামূলক সচেতন প্রোডাকশন হাউসগুলোও আজকাল ক্ষমতায়িত নারীর চিত্রায়ণে এগিয়ে এসেছে, যা প্রশংসারও দাবিদার। তবে ক্ষমতায়নের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাবে এই প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রেই লেজেগোবরে হয়ে উঠছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বাস থেকে নারীর সক্ষমতার চিত্রায়ণ আর এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চিত্রায়ণের মধ্যে রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শেষের কবিতায় উল্লেখ করেছিলেন ‘মনে নেয়া’ আর ‘মেনে নেওয়া’র পার্থক্যের বিষয়টি। ‘মনে না নিয়ে’ যে ‘মেনে নেওয়া’, তার চিত্রায়ণে নানান বিড়ম্বনা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই চিত্রায়ণ যতই চটকদার হোক না কেন, সেখানে রয়ে যাবে ফাঁক। বিশ্বাসবিহীন চিত্রায়ণের তাগিদ নারীকে ক্ষমতায়িত না করে উল্টো তাঁর অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে অনেক ক্ষেত্রে। অন্যদিকে নারীর সক্ষমতা সম্পর্কে অতি উদার মন্তব্য ও মূল্যায়নও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কারণ, এ ধরনের অতিশায়োক্তি ও অবিবেচক মন্তব্য নারীকে কয়েক গুণ দায়িত্বের বোঝা নিতে বাধ্য করে। ‘আমি নারী, আমি সব করতে পারি’, কিংবা ‘আমার মা সব পারেন’ এ ধরনের উক্তিগুলো নারীর প্রতি সমাজের প্রত্যাশার ভার এতটাই বাড়িয়ে দেয় যে দায়িত্বের ভারে নারী হাঁসফাঁস করতে থাকেন। আগের নারীর প্রচলিত রূপটি ছিল শুধুই সংসার আর সন্তান পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত নারীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ আর অর্থ উপার্জন করার বিষয়টি এখন আর নতুন নয়। এবার কিন্তু নারীর প্রতি ছুড়ে দেওয়া হয়েছে অন্য চ্যালেঞ্জ। নারীর আগের চ্যালেঞ্জটি ছিল সে ঘর সামলে চাকরি করতে পারবে কি না। আর এখনকার চ্যালেঞ্জটি হলো, সে চাকরি সামলে ঘর-সংসারের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারবে কি না। কিন্তু চ্যালেঞ্জ থেকে নারীর কোনো মুক্তি নেই। অথচ পুরুষেরা আছেন বেশ। ঘরে এবং বাইরে নারীর পদচারণে মুখর পরিবর্তিত সময়ে পুরুষ নিজেদের মানিয়ে নিতে কতটা দক্ষ হয়ে উঠেছেন, সেই চ্যালেঞ্জ তাঁকে কেউ কখনো দেয় না। অথচ নারীকে বারবার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই প্রমাণ করতে হয় যে তিনি সক্ষম।
সমাজে নারী আর পুরুষের কাজের যে বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে, তা নারীকে বঞ্চিত করার একটি রাজনীতি ছাড়া আর কিছু নয়। নারীর সক্ষমতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী আর শ্রদ্ধাশীল মন কখনোই চিত্রায়ণে সংসার আর কর্মক্ষেত্রের গাদা গাদা রসদ তাঁর হাতে তুলে দিত না। নারীর সক্ষমতার এ ধরনের চিত্রায়ণ হয় তাঁকে অবমূল্যায়ন করে, না হয় তাঁর কাছ থেকে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা সমাজের প্রত্যাশাকে এতটাই আকাশচুম্বী করে ফেলে, তা পূরণ করতে নারীর অতিমানবী হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। প্রশ্ন হলো, নারীকে সবকিছু পারতে হবে কেন? পুরুষকে তো কখনো তাঁর সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হয়নি। তাহলে নারীকে কেন তাঁর সক্ষমতার জন্য প্রমাণ দিতে হবে? সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নারী শুধু তাঁর সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েই চলেছেন। সিমোন দা বোভোয়ার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য সেকেন্ড সেক্স -এর ভূমিকার একাংশে বলেছিলেন, ‘নারীর নিকৃষ্টতা প্রমাণের জন্য নারীর ক্ষমতায়নের বিপক্ষ শক্তি ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, এমনকি কৌশল পরিবর্তনও করে। ধর্ম, দর্শন কিংবা ধর্মতত্ত্বের দোহাই দিয়ে যদি নারীকে আটকে রাখা সম্ভব না হয়, তখন বিজ্ঞানের সাহায্য পর্যন্ত নেওয়া হয়।’
শ্রমবাজারে নারীর উপস্থিতি ও মজুরি নিয়ে ইতিহাসে বারবার রাজনীতি হয়েছে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞানসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সক্ষমতাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তাই এবার প্রকৃত অর্থেই বন্ধ হোক নারীর সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার সব আয়োজন। নারীকে মহান করার ছলে তাঁর কাঁধে পুনরায় দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কিংবা নারীর জন্য সাফল্যের মানদণ্ড বেঁধে দেওয়ার রাজনীতি এবার বন্ধ হোক। নারী দেবী নয়, মর্ত্যের মানবী। আর তাই নারী মুক্তি লাভ করুক সবার প্রত্যাশা পূরণের দেবীর আসন থেকে। মানবী নারী তাঁর বাস্তব জীবনে সম্মানিত হোক, মূল্যায়িত হোক, স্বীকৃতি লাভ করুক।
নিশাত সুলতান লেখক ও গবেষক
purba_du@yahoo.com