ফ্রান্সে মধ্যপন্থীরা কী করবে, বামে নাকি ডানে যাবে

ফ্রান্সে মধ্যপন্থীরা কী করবে, বামে নাকি ডানে যাবে
ফ্রান্সে মধ্যপন্থীরা কী করবে, বামে নাকি ডানে যাবে

ফ্রান্সে মধ্যপন্থীরা কী করবে, বামে নাকি ডানে যাবে

ফ্রান্সের নির্বাচনের প্রথম দফায় জয়ী মারিঁ লো পেন

মাত্র তিন সপ্তাহ আগে তাড়াহুড়া করে গঠন করা একটি জোটের জন্য ভোটের ফলটিকে বেশ ভালোই বলতে হবে। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত গত রোববারের প্রথম দফার ভোটে বামপন্থীদের জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট প্রায় ৯০ লাখ ভোট পেয়েছে।

তারা মারিঁ লো পেনের কট্টর ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র‍্যালির (আরএন) পেছনে পড়লেও প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও তাঁর মিত্রদের চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে এগিয়ে আছে।

ফলে ৭ জুলাই অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আগে ফরাসি ভোটারদের যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তা হলো তাঁরা কি মধ্য-বাম ঘরানার কিছু দল নিয়ে গঠিত জোট সরকার চান, নাকি তাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চাবি কট্টর ডানপন্থীদের হাতে তুলে দিতে চান?

মাখোঁ যে আশায় আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা যে আর হচ্ছে না, সেটি এখন মোটামুটি নিশ্চিত।

মাখোঁ যে ধারণার ওপর নির্ভর করে আগাম নির্বাচন দেওয়ার মতো মহা ঝুঁকিপূর্ণ বাজি ধরেছিলেন, তা হলো, বামপন্থী দলগুলো এক হতে পারবে না। কিন্তু বাম ঘরানার দলগুলো চট করেই সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে।

আরও পড়ুন

ইউরোপ কীভাবে বিশ্ব জয় করেছে

বাম দলগুলো এমন একটি সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মসূচি ধরে এক হয়েছে, যা মাখোঁর অর্থনৈতিক কর্মসূচির চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

একই সঙ্গে মারিঁ লো পেনের কট্টর দল আরএনের অভিবাসী হয়রানি ও জাতিভিত্তিক ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট মাখোঁর দলের নেতৃত্বাধীন জোট এনসেম্বল অ্যালায়েন্সের চেয়ে বাম দলগুলোর জোট নিজেদের আরও বেশি কার্যকর বলে প্রমাণ করতে পেরেছে।

তবে ফ্রান্সের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে থাকা কট্টর ডানপন্থীদের আধিপত্য গোটা দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। তাদের এই বাড়বাড়ন্ত প্রবণতা বাস্তবসম্মত এবং এটিকে উপেক্ষা করার সুযোগ খুবই কম।

নরম্যান্ডির উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল পর্যন্ত কট্টরপন্থীদের ঢেউটি ফ্রান্সের প্রাণকেন্দ্রে আছড়ে পড়ছে। এই দৃশ্যপটের সঙ্গে মার্কিন নির্বাচনের মিল পাওয়া যাচ্ছে।

রিপাবলিকান পার্টিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্টির পর কাউন্টিতে যেভাবে প্রাধান্য বিস্তার করতে দেখা যাচ্ছে, ফ্রান্সের গ্রামীণ অধ্যুষিত এলাকাতে একইভাবে মারিঁ লো পেনের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।

তবে আপনি যদি ফ্রান্সের মানচিত্রের দিকে একটু ঘনিষ্ঠ নজর দিয়ে তাকান, তাহলে দেখবেন, এই ফ্রান্সের মধ্যে আরও একটি ‘ফ্রান্স’ আছে।

আরও পড়ুন

ইউরোপে কথা বলার অধিকার যে কারণে আত্মপ্রতারণা

খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাম ঘরানার দলগুলোর জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট প্যারিস, লিয়ন ও টুলুজের মতো যেসব শহরে জয়লাভ করেছে, সেখানে কর্মজীবী শ্রেণির অভিবাসী ও তাঁদের বংশধরদের একটি বড় অংশ রয়েছে।

একটি বৈচিত্র্যময় সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার রক্ষায় ফ্রান্স এসব অভিবাসীকে সুরক্ষা দিয়ে এসেছে, যা ফরাসি নাগরিক হিসেবে তাঁদের পূর্ণ অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়ে রেখেছে।

গ্রামীণ ফ্রান্সের এই শ্রমিক শ্রেণি এখনো প্রবলভাবে বামপন্থীদের দিকে ঝুঁকে আছে। এ ছাড়া ফ্রান্সের তরুণেরাও স্পষ্টতই বামপন্থী ধারার হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইপসোস-এর সমীক্ষা অনুসারে, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ভোটারদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নিউ পপুলার ফ্রন্টকে ভোট দিয়েছেন।

প্রচারকাজে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া, জোটের ভেতরের সুস্পষ্ট উত্তেজনা এবং প্রতিপক্ষের জোরালো মাত্রার শত্রুতা সত্ত্বেও লক্ষণীয়ভাবে নিউ পপুলার ফ্রন্ট ভালো ফল করেছে।

২০২২ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডের ফলের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, সেবারের তুলনায় বাম জোট তাদের ভোট প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে।

তবে মাখোঁর নেতৃত্বাধীন জোট কেন ভালো করতে পারেনি, তা নিয়ে কোনো ধোঁয়াশা নেই।

বেশ কয়েক মাস ধরে এই জোটের ভেতরকার ছোট ছোট দল মাখোঁর অনুসারী উচ্চপদস্থ নেতাদের ভয়ংকর আক্রমণের শিকার হয়েছিল। বামপন্থী জোটকেও তাঁরা সমানে আক্রমণ করেছেন। আক্রমণকারীদের মধ্যে স্বয়ং মাখোঁও ছিলেন।

আরও পড়ুন

ইউরোপে নতুন এক অন্ধকার যুগ নেমে আসছে?

ইউরোপে নতুন এক অন্ধকার যুগ নেমে আসছে?

নাগরিকদের লিঙ্গ পরিবর্তন করা সহজ করার জন্য নিউ পপুলার ফ্রন্টের দিক থেকে যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেই প্রস্তাবকে মাখোঁ খুব উৎকটভাবে উপহাস করেছিল।

তিনি বামপন্থীদের এই প্রস্তাবটিকে ‘অভিবাসনবাদী’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। এটি চরম ডানপন্থী মারিঁ লো পেনের ব্যবহৃত একটি বিশেষণ, যা ফরাসি অভিধানে নেই।

মাখোঁ বামপন্থী জোটকে চরম ডানপন্থী দল আরএনের কাতারে নিয়ে এসে তাদের সমালোচনা করেছেন এবং তাদের ভোট দিতে দেশবাসীকে বারণ করেছেন।

ইতিমধ্যে অজনপ্রিয় হয়ে পড়া মাখোঁর মুখে এসব কথাবার্তা শুনে মধ্যপন্থী ভোটাররা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এটিও মধ্যপন্থীদের বাম জোটকে ভোট দিতে উৎসাহিত করেছে।

শেষ কথা, ফ্রান্স এর আগেও একাধিকবার লো পেনের হাত থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য বামপন্থী দলগুলো ও ভোটারদের সহায়তা পেয়েছে। সেই একই ধরনের হুমকি আবার দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সব গণতন্ত্রকামীকে এক হয়ে লড়তে হবে