ফেনীতে বন্যা দুর্গত এলাকায় মিলছে না চিকিৎসাসেবা
মো. আলমগীরের তিন সন্তান দুই দিন ধরে জ্বর, সর্দি ও কাশিতে আক্রান্ত। পানিতে ভেজার কারণে এমনটা হয়েছে বলে ধারণা তাঁর। সাত দিন আগে তাঁরা সবাই আশ্রয় নেন ফেনী সদরের লেমুয়া ইউনিয়নের নেয়ামতপুর গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে।
ওই বিদ্যালয়ের আশপাশ ও রাস্তায় আজ মঙ্গলবারও বুকসমান পানি ছিল। কোথাও হাঁটুপানি। তাই সন্তানদের নিয়ে বের হননি আলমগীর। চল্লিশোর্ধ্ব এই অটোরিকশাচালক বছর পাঁচেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা হারান। তাই পানি মাড়িয়ে দূরে গিয়ে ওষুধ আনার ব্যবস্থাও নেই।
আলমগীর প্রথম সময় কে বলেন, তাঁদের স্কুলে আরও ১০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। শিশু আছে ৫–৬ জন। কমবেশি সবাই অসুস্থ। কিন্তু কোনো চিকিৎসাসেবা তারা পায়নি। কমিউনিটি হাসপাতালও পানিতে ডুবে গেছে। ওষুধপত্র নষ্ট হয়েছে।
আক্ষেপ করে আলমগীর বলেন, তাঁর দুই পা সচল থাকলে পানিতে সাঁতার কেটে হলেও ওষুধ নিয়ে আসতেন। কিন্তু সে সুযোগও নেই। পা কেটে ফেলতে হয়েছে অনেক আগেই।
শুধু আলমগীর নন, দুর্গম গ্রামের বিভিন্ন স্থায়ী-অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া দুর্গত মানুষ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না। পানির কারণে গ্রামে গ্রামে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ফেনী জেলার সিভিল সার্জন শিহাব উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, পানি বেশি হওয়ার কারণে গ্রামে গ্রামে চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে ইতিমধ্যে ছয় উপজেলায় ছয়টি জরুরি দল গঠন করা হয়েছে। ক্যাম্পের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে বিশেষজ্ঞ দল ফেনীতে এসেছে। পানি নেমে গেলে স্থায়ী ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে সেবা দেওয়া হবে।
অন্যদিকে ফেনী সদর হাসপাতালে সেবা দেওয়া হচ্ছে। পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পানি নেমে যাওয়ার পর সেবা চালু হয়েছে। কিন্তু গ্রামগুলোতে কোনো চিকিৎসক দল যায়নি।
গত দুই দিন ফেনী সদরের ফাজিলপুর, লেমুয়া এলাকার চারটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, বেশ কিছু শিশু জ্বর ও সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়েছে।
ফাজিলপুর ইউনিয়নের পুর্বালী গ্রামের একটি মাদ্রাসায় আশ্রয় নেন ফারজানা আক্তার ও তাঁর তিন সন্তান। তাঁর পানিতে ভিজে ১৩ মাস বয়সী ছেলে মোহাম্মদ আপ্পানের দুই দিন ধরে জ্বর। সাড়ে চার বছরের মেয়ে সাদিয়া আক্তারের সর্দি। আশ্রয়কেন্দ্রের চারপাশে বুকসমান পানি হওয়ায় বেরই হতে পারেননি তাঁরা। চিকিৎসকের পরামর্শও পাননি।
ফারজানা বলেন, কোনো জামা-কাপড় বের করতে পারেননি। এক কাপড়ে বের হতে হয়েছে। ভেজা কাপড় গায়ে থাকায় দুই সন্তান জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছে।
সদর উপজেলার ১০ নম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের উত্তর টংগিরপাড় হাজী বাড়ি মসজিদ এলাকার বাসিন্দা তানিয়া আক্তার জীবন বাঁচাতে স্থানীয় একটি মসজিদে আশ্রয় নেন এক সপ্তাহ আগে। তাঁর চার বছরের শিশুও জ্বর–সর্দিতে আক্রান্ত। তানিয়া জানান, গ্রামের রাস্তাঘাট এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। এ কারণে কোনো স্বাস্থ্যকর্মী গ্রামে যাননি। সেবাও পাননি।
তুলাবাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়ে ১৫৫ পরিবারের কয়েক শ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। নৌকাযোগে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, চারতলা ও দোতলার দুটি ভবনে গাদাগাদি করে মানুষ থাকছে। মেঝেতে চাটাই বিছিয়ে শুয়ে ছিল একাদশের ছাত্রী অর্পিতা দাশ। গত দুই দিন তার জ্বর ওঠানামা করছে। আজ জ্বর ১০২ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যায়। পাশে মা প্রিয়াঙ্কা রানি দাশ বসে মেয়েকে জলপট্টি দিচ্ছিলেন। তিনি প্রথম সময়কে বলেন, স্কুলের আশপাশে পানি আর পানি। মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জ্বরের কারণে সে মাথা তুলতে পারছে না। সাত দিন ধরে তাঁরা আছেন সেখানে।
ত্রাণ কেউ পাচ্ছেন, কেউ পাচ্ছেন না
ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা, সোনাগাজী—এই ছয় উপজেলা পুরোপুরি বন্যাকবলিত। পাঁচ দিন ধরে গ্রামগুলো পানিতে তলিয়ে ছিল। গত দুই দিনে পানি কিছুটা সরেছে। বুকসমান পানি নেমে এখন হাঁটুতে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যায় আট লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে দেড় লাখ মানুষ জেলার বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। আবার অনেকেই প্রতিবেশীর দোতলা ও তিনতলার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। এসব জায়গায় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ত্রাণ এসেছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে দুর্গত সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছায়নি।
জানা গেছে, গত পাঁচ দিনে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৬২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা হেলিকপ্টারে ৩৮ হাজার খাবার প্যাকেট বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দিয়েছেন। আবার স্বেচ্ছাসেবকেরাও ট্রাকে ট্রাকে ত্রাণ এনেছেন।
গত পাঁচ দিন সরেজমিন ঘুরে, স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেনী সদরের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া গ্রামগুলোতে বেশি পরিমাণে ত্রাণ গেছে। কিন্তু ভেতরের দুর্গম গ্রামে ত্রাণ গেছে খুব কম। নৌকার অভাবে ত্রাণ নিয়ে ভেতরে যেতে পারেননি স্বেচ্ছাসেবকেরা। লালপোল, বড় বাজার, কসকা, খাইয়ারা রাস্তার মাথা, ফাজিলপুর, মুহুরীগঞ্জ, নতুন মুহুরী গঞ্জ, নিজকুনজরা, ধুমঘাট সেতু এলাকার অনেকেই কয়েকবার করে ত্রাণ পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ একবারও পাননি।
মহাসড়ক লাগোয়া ছনুয়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল বাছিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের গ্রামে পাঁচ-ছয় ট্রাক ত্রাণ গেছে। কিন্তু ভেতরের লস্করহাটের দিকে এক–দুই ট্রাকের বেশি যায়নি।
লেমুয়া ইউনিয়নের নেয়ামতপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় বয়োবৃদ্ধ কালাম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, তাঁদের গ্রামে দুই দিন ত্রাণ পৌঁছেছে। তবে সবাই পাননি। কেউ কেউ দুবার পেয়েছেন।
জেলা প্রশাসক মোছাম্মৎ শাহীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তালিকা করে সরকারি ত্রাণ সহযোগিতা দেওয়া হবে। অনেক স্বেচ্ছাসেবককে জেলা প্রশাসন সহযোগীতা করেছে। কিন্তু অসংখ্য মানুষ নিজেদের মতো করে ত্রাণ দিচ্ছেন।
পানি নামছে ধীরে
ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর, সোনাগাজী, পরশুরামের বেশির ভাগ গ্রাম থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। গত দুই দিনে বুকসমান পানি নেমে এখন হাঁটুপানিতে। কোথাও কোথাও সড়কের ওপর থেকে পানি পুরোপুরি সরে গেছে।
অবশ্য বন্যার পানি নামতে দেরি হচ্ছে। ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে এক সপ্তাহ ধরে কহুয়া, মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি উপচে গ্রামে গ্রামে ঢুকে পড়েছিল।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহরিয়ার হাসান প্রথম আলোকে বলেন, নদী ও খাল পানিতে টইটম্বুর। এ কারণে পানি নামতে দেরি হচ্ছে।