গ্যাস সংকট চরমে দিনে জ্বলে না চুলা রাতে চলে রান্না।
হাসান আজাদ
জাহানারা আলম, রাজধানীর পূর্ব জুরাইনের বাসিন্দা। বেশ কিছুদিন ধরে বদলে গেছে তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। কারণ গ্যাস সংকটে দিনের বেলা বন্ধ হয়ে গেছে রান্নাবান্না। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয়—কখন জ্বলবে চুলা। এরপর গ্যাস এলে একসঙ্গে তিন বেলার খাবার রান্না করতে হয়। কারণ ঘুম থেকে উঠে আর গ্যাসের দেখা মেলে না। এভাবে রাত জেগে রান্না করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন জানিয়ে জাহানারা আলম কালবেলাকে বলেন, ‘গ্যাস সংকটের কারণে গভীর রাতে জেগে রান্নার কাজ করতে হয়। সেজন্য ঘুম হয় না। আর দিনের বেলায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। বাসার অন্যান্য কাজ করতে হয়। ফলে টানা বেশিক্ষণ ঘুমানোর সুযোগ হয় না।’ এই গৃহিণী আরও জানান, ‘গ্যাস সংকটের কারণে গত মাসে একটি ইলেকট্রিক ওভেন কিনেছেন। রাতের তৈরি করা রান্না প্রতি বেলায় ওভেনে গরম করে খাচ্ছেন; কিন্তু এর বিপরীতে বিদ্যুতের বিল আসছে অনেক বেশি। আবার গ্যাস না পেলেও বিল দিতে হচ্ছে ঠিকই। পাশাপাশি গ্যাসের অভাবে খাবার তৈরিতে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে এবং চিকিৎসার জন্যও খরচ হচ্ছে। সব মিলিয়ে গ্যাস সংকটের কারণে তিন দিকে অনাকাঙ্ক্ষিত খরচ বেড়েছে। এক মাস ধরেই এটা চলছে। এটা তো আমাদের মতো চাকরিজীবীদের ওপর প্রচণ্ড চাপ।’ শুধু জুরাইন নয়, মহাখালী, পল্লবী, কাফরুল, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০, রায়েরবাগ, গ্রিন রোড, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, মগবাজার, মালিবাগ, রামপুরা, বনশ্রী, বাসাবো, আরামবাগ, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, উত্তরাসহ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায়ই এখন এমন অবস্থা। দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাসাবাড়িতে গ্যাসের সরবরাহ থাকে না। কোথাও দুপুরের পর, কোথাও সন্ধ্যায়, আবার কোথাও গভীর রাতে মেলে গ্যাসের দেখা। ফলে ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ বাধ্য হয়ে জীবনযাত্রা বদলে ফেলেছেন। আরও ভয়াবহ অবস্থা শিল্পকারখানায়। ঢাকার আশপাশের শ্যামপুর, কাঁচপুর, ভুলতা ও রূপগঞ্জের একাধিক শিল্পকারখানার কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। রড উৎপাদনে গ্যাস অন্যতম সাশ্রয়ী উপকরণ। এই শিল্প-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। গ্যাসের অভাবে ফার্নেস অয়েল বা ডিজেল ব্যবহার করে উৎপাদন করতে হচ্ছে। একই অবস্থা সারা দেশে রড উৎপাদকদের। দেশে রড উৎপাদনকারী অন্যতম প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত জানান, ‘এখন চাহিদার বিপরীতে আমরা ৬০ শতাংশের মতো গ্যাস পাচ্ছি। বাকি চাহিদা মেটাতে হচ্ছে জ্বালানি তেল দিয়ে। গ্যাসের দাম যেখানে ৩০ টাকা, সেখানে তেলের দাম ১০৫ টাকা। ফলে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে রডের দামও বেড়ে গেছে।’ শিল্পকারখানায় গ্যাস সংকট নিয়ে নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালবেলাকে বলেন, ‘গ্যাস সংকট নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা হয়রান। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার কথা বলে দাম বাড়ানো হয়েছিল। এখন বাড়তি দামেও গ্যাস দিতে পারছে না। গ্যাস না পাওয়ার কারণে অর্ধেকে নেমে এসেছে উৎপাদন। সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। শিপমেন্ট শিডিউল ফেইল করার কারণে ক্রেতারা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অর্ডার বাতিলের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আসলে আমরা ব্যবসায়ীরা এখন অসহায়।’ বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক হোসেন মেহমুদ বলেন, ‘কোনো কোনো দিন ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া যায় না। গ্যাস থাকলেও চাপ এতই কম থাকে, যা দিয়ে উৎপাদন করা যায় না। এতে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। অপচয়ের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। অন্তত ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে গ্যাস সংকটের কারণে। গ্যাস না পাওয়ার কারণে অনেক কারখানা আগের চেয়ে অর্ডার নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে।’ গ্যাসের সংকট শুধু শিল্প বা বাসাবাড়িতেই নয়, পরিবহনে ব্যবহৃত সিএনজিরও সংকট চলছে। রাজধানীর অধিকাংশ সিএনজি স্টেশন শুধু গভীর রাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা গ্যাস পায়। আবার সেই সময়ও প্রেশার কম থাকে। সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর জানান, ‘সরকার ঘোষিত বন্ধের সময়ের বাইরেও গ্যাসের অভাবে সকাল ৭টা থেকে দুপুর আড়াইটা-৩টা পর্যন্ত বেশিরভাগ স্টেশন বন্ধ থাকে। দুপুরের দিকে আর গভীর রাতে কিছুটা গ্যাস পাওয়া গেলেও পর্যাপ্ত চাপ থাকে না। ফলে মেশিন চালানো যায় না। আবার চাপ কম থাকার কারণে ক্রেতারও লোকসান হয়।’ সংশ্লিষ্টরা জানান, শীত শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে প্রকট আকার ধারণ করেছে গ্যাসের সংকট। শীতে সাধারণ বিদ্যুতের চাহিদা কমে থাকলেও কয়েক বছর ধরে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে কয়েক বছর ধরে শীতে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা গেছে। এ ছাড়া এখন সার কারখানায়ও চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না। চলমান গ্যাস সংকট নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘প্রতিবছরই শীতে পাইপলাইনে পানি জমার কারণে গ্যাসের সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া এই সময়ে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় গ্যাসের চাহিদাও বেড়ে যায়। এবার এর সঙ্গে সরবরাহের অপ্রতুলতা যোগ হয়ে সংকট তীব্র হয়েছে। কারণ দেশের দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি সংস্কারের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আরেকটি টার্মিনাল নিয়মিত সার্ভিসিংয়ে যাবে। সেটি মার্চ নাগাদ চালু হবে। এলএনজি টার্মিনালটি সংস্কার শেষে দেশে না আসা পর্যন্ত গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো পেট্রোবাংলার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।’ তিনি জানান, ‘আগামী মার্চ মাসের মধ্যে গ্যাস সংকট সমাধান হয়ে যাবে। আর ২০২৬ সালের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।’ তবে পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, বছরজুড়েই থাকবে গ্যাসের সংকট। যদিও তা এখনকার মতো তীব্র হবে না। রেশনিং করে এই সংকট মোকাবিলার চিন্তা করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট পাওয়া যাচ্ছে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে। এই হিসাবে ঘাটতি থাকছে ১ হাজার ৭৫০ মিরিয়ন ঘ।