মেয়ের নাম স্পৃহা রেখে আইসিইউ থেকে মায়ের চিরবিদায়
স্পৃহাকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। ওর মাকে আইসিইউতে নেওয়ার পর ওকে বাসায় আনা হয়। এর আগে ও মায়ের বুকের দুধ খেয়েছে। সুমনা জানালেন, গত ২১ জুলাই থেকে লাবণীকে নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা। দীর্ঘ নয় বছর পর লাবণী মা হতে যাচ্ছেন অন্যদিকে করোনাকাল, তাই তাঁর প্রতি যত্নটাও বেশি নিতে হয়েছে। সঞ্জয় ব্যাংকে চাকরি করেন, তাই বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই আলাদা ঘরে থাকতেন। তবে শেষ পর্যন্ত এসব সচেতনতাও রক্ষা করতে পারেনি লাবণীকে।
২১ জুলাই প্রথম লাবণীর জ্বর আসে। এ ছাড়া করোনার আর কোনো উপসর্গ ছিল না। লাবণীকে পারিবারিক চিকিৎসক নাপা খাওয়ার পরামর্শ দেন। তারপর জ্বর ছেড়ে যায়। আবার জ্বর আসে ২৫ জুলাই। লাবণী একবার শুধু বলেছিলেন, খাবারের স্বাদ ও গন্ধ পাচ্ছেন না। তবে এক দিন পরই জানিয়েছিলেন এসব সমস্যা আর নেই। ২৬ তারিখ করোনা পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল দেওয়া হয়। ২৭ তারিখ জানা যায়, সঞ্জয় করের করোনা পজিটিভ, তবে লাবণীর করোনা নেগেটিভ। সঞ্জয় কর করোনার দুটো টিকা নিয়েছেন। তবে লাবণীর বয়স ছিল ৩০ বছর, আর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তাঁকে টিকা দেওয়া হয়নি।
সুমনা বলেন, ২৭ জুলাই আবার জ্বর এলে অন্য আর একটি সংস্থার লোকজন লাবণীর স্যাম্পল বাসা থেকে নিয়ে যান। ডেঙ্গুর পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। কাগজে-কলমে করোনা নেগেটিভ এলেও লাবণীর বিভিন্ন টেস্টের ফাইল নিয়ে মেডিসিন বিশেষজ্ঞসহ কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। পেটের সন্তান যাতে কোনো ঝুঁকিতে না পড়ে, ১২ ঘণ্টার বিরতিতে চিকিৎসক লাবণীকে দুটো ইনজেকশন দেন। এই সব জটিলতার আগে লাবণীর প্রস্রাবে সংক্রমণ দেখা দিলে তখন তাঁকে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয়েছিল।
২৭ জুলাইয়ের জ্বরের পর লাবণী কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। আরেকটি সংস্থা যে রিপোর্ট দেয় তাতে সঞ্জয় ও লাবণীর করোনা পজিটিভ আসে।
সুমনা আক্ষেপ করে বলেন, ‘লাবণীর করোনা পজিটিভ এ রিপোর্টটা যদি প্রথমবারই আসত, তাহলে আরও আগেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারতাম। করোনা নেগেটিভ দেখে হাসপাতালে ভর্তি করতে সাহস পাইনি। ভেবেছিলাম, এ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করলে তাকে যদি করোনা ওয়ার্ডে দিয়ে দেয়। করোনা পজিটিভ দেখে মাথায় নতুন চিন্তা ভর করে, হাসপাতালে আইসিইউ বা বাচ্চা যদি আগেই ডেলিভারি করতে হয়, তাহলে বাচ্চার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে, এমন হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। করোনার এ পরিস্থিতিতে আইসিইউ পাব তো?’
সুমনা বলেন, ‘সিজারের পর মুখে খাবার খেতে শুরু করে লাবণী, বাসায় রান্না করা পাতলা ডাল দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিল। তাঁর জন্য ডাল, মাছ, ভাজি পাঠালে মজা করেই খেয়েছিল। ৩০ জুলাই লাবণীর অক্সিজেন লেভেল কমতে শুরু করে। তারপর আইসিইউ, লাইফ সাপোর্ট সব দিয়েও বাঁচানো গেল না।’
করোনা মানুষকে বিশেষ করে ভুক্তভোগী পরিবারকে কতটা বিপর্যস্ত করে ফেলেছে সে প্রসঙ্গে সুমনা বলেন,‘ লাবণীকে শ্মশানে রেখে আসলাম। সঞ্জয়ের করোনা, তাই আমরা তাকে ধরে একটু সান্ত্বনাও দিতে পারিনি। মেয়ে আমার কাছে, তাই সঞ্জয়কে একা তাঁর ফ্ল্যাটে পাঠাতে বাধ্য হলাম। ভাইবোনেরা একসঙ্গে ভিডিও কল দিয়ে ভাইকে বলি, কোনো কথা বলার দরকার নেই, তুই শুধু আমাদের কথা শুনবি। তারপর ঘুমিয়ে যাবি। ভিডিও কলে ভাই অনেকক্ষণ হাউমাউ করে কান্নাকাটি করে। আমাদের কথা শুনতে শুনতে একসময় ভাই ঘুমিয়ে গেলে আমরা ফোন ছাড়ি। তারপর থেকে ভিডিও কলেই ও তার মেয়েকে দেখছে আর কান্নাকাটি করছে।
সুমনা বলেন, ‘লাবণী হয়তো বুঝতে পেরেছিল তার হাতে আর সময় নেই। তাই আইসিইউতে থাকা অবস্থায় সে তার স্বামীর কাছে মেয়ের নামটা বলে গিয়েছিল। স্পৃহা মানে ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা। এই মেয়েকে পেতেও তো লাবণীকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। অথচ মেয়ের মুখটাও সেই অর্থে সে দেখতে পেল না। অপারেশন থিয়েটারে মেয়েকে যেটুকু দেখা সেটুকুই। মেয়েটার মায়ের সঙ্গে কোনো ছবিও নেই।’
প্রথম আলোর জন্য স্পৃহার একটি ছবি চাইলে সুমনা বলেন, ‘ওর মায়ের সঙ্গে কোনো ছবি নেই। পিসি বা ফুফুর সঙ্গে ছবি দিয়ে কী হবে? আপনারা সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন, মা হারা মেয়েটা যেন ভালো থাকে