মাটির ঘরে বসে উপকূলের কষ্টগাথা শুনলেন রাজকন্যা।
সাবরিনা আক্তার
সুইডেনের রাজকন্যা ভিক্টোরিয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল সুশোভিত শামিয়ানা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে গ্রামের নারীদের মাটির ঘরে গিয়ে বসলেন তিনি। শুনলেন উপকূলের নোনাপানির মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা। এ সময় গ্রামের নারীদের সঙ্গে ছবিও তোলেন। পুকুরে নারীদের মাছ ধরা দেখে বিস্মিত হন কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা বাস্তবের রাজকন্যা। পোস্ট অফিস উদ্বোধন করতে গিয়ে পটগান শুনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তিনি। মঙ্গলবার এভাবেই সফরের পুরোটা সময় কাটালেন জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) শুভেচ্ছাদূত সুইডেনের রাজকন্যা। তাঁর চার ঘণ্টা সফরের পুরোটা সময় স্বপ্নের মতো কেটেছে কয়রার মানুষের কাছে। রাজকন্যার সাদামাটা জীবন দেখে আপ্লুত হয়েছেন গ্রামীণ নারীরা এদিন সকাল পৌনে ৮টার দিকে কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের ভিকেএস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে রাজকন্যাকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি অবতরণ করে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকা স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান রাজকন্যাকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় দূর থেকে রাজকন্যা ভিক্টোরিয়াকে এক পলক দেখার জন্য বিভিন্ন স্থানে গ্রামের মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। হেলিকপ্টার থেকে নামার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ইউনিয়নের নয়ানি যজ্ঞ মন্দিরের মাঠে। সেখানে ইউএনডিপির অর্থায়নে স্থাপিত রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টারের সুবিধাভোগীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন তিনি। গ্রামের নারীরা রাজকন্যার কাছে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত সমস্যার কারণে অতীতে পানযোগ্য পানির সংকটের কথা তুলে ধরেন। তারা জানান, আগে গ্রামীণ উৎস থেকে পরিবারের পানযোগ্য পানি সংগ্রহের জন্য নারীদের বাড়ি থেকে দূরে যেতে হতো। আবার অনেক সময় লবণমুক্ত পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ত। এখন নতুন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম হওয়ার পর সহজেই লবণমুক্ত বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্য তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে শিকারিবাড়ি এলাকা পরিদর্শনে যান ইউএনডিপির শুভেচ্ছাদূত। সেখানে লজিক প্রকল্পের আওতায় জলবায়ু সহনশীল জীবিকায়নের অংশ হিসেবে ভেড়া পালন, মৎস্য চাষ এবং জলবায়ু ও জীবিকা উন্নয়ন সমবায় সমিতির মধু বিপণন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। সেখানে কয়েকজন নারী উদ্যোক্তার খামার পরিদর্শন শেষে উদ্যোক্তাদের কাছে সুবিধা-অসুবিধাগুলো জানতে চান। এ সময় আমেনা খাতুন ও ঊর্মিলা মণ্ডল নামে দু’জন উদ্যোক্তার মাটির ঘরের বারান্দায় বসে কথা বলেন রাজকন্যা। রাজকন্যাকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তারা। রাজকন্যার কাছে নিজেদের গল্প উপস্থাপন করতে পেরে নিজেদের খুবই ভাগ্যবান মনে করেন এ দুই নারী। আমেনা খাতুন বলেন, ‘নিজ চোখে রাজকইন্যা দেখব স্বপ্নেও ভাবিনি। সে আজ আমার ভাঙা ঘরের বারান্দায় আইসে বসিছে। আমাগে খবর নিছে।’ ইউএনডিপির অর্থায়নে লজিক প্রকল্পের মাধ্যমে শিকারিবাড়ি এলাকায় ৩০ নারীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ চলছে। রাজকন্যা সেসব নারীর পারিবারিক জীবনের খোঁজখবরও নেন। একই সময় রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টারের ৪০০ সুবিধাভোগীর খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি এলাকার মানুষের খাবার পানির সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হন তিনি। সকাল পৌনে ১০টার দিকে গাড়িতে প্রায় ১৩ কিলোমিটার সড়কপথে মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদে পৌঁছান রাজকন্যা ভিক্টোরিয়া। সকাল সোয়া ১০টায় সেখানে উপস্থিত হলে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ঢোলের বাদ্য বাজিয়ে রাজকন্যাকে অভিবাদন জানান। সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে ডিজিটাল সেন্টারের সুবিধা ও সেবাগুলো নিয়ে পটগানের পরিবেশনা উপভোগ করেন। এ সময় ব্যাংকে ডিপোজিটের টাকা জমা দিতে আসা রেশমা খাতুন নামে এক সেবাগ্রহীতার হাতে জমা রসিদ তুলে দেন শুভেচ্ছাদূত। রেশমা খাতুন বলেন, ‘রাজকন্যার হাত থেকে জমা রসিদ নিতি পাইরে নিজেরে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। রাজকন্যা হলিও খুবই সাধারণ মানুষ মনে হয়েছে তাঁকে।’ ডিজিটাল সেন্টারের দায়িত্বরত নারী উদ্যোক্তা শিউলি বাছাড় বলেন, রাজকন্যা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে ডিজিটাল সেন্টারের সেবাগ্রহীতা ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি এলাকার মানুষের জীবনমান সম্পর্কে জানতে চান। দেশের সর্ব দক্ষিণের এলাকা হলেও ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে কীভাবে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি, তা রাজকন্যাকে বুঝিয়ে বলি। তিনি আমাদের শুভেচ্ছা জানান এবং আরও ভালোভাবে কাজ করতে উৎসাহ দেন। মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তিনি কয়রা উপজেলা পোস্ট অফিসে গিয়ে স্মার্ট পোস্ট সেন্টারের উদ্বোধন করেন এবং দু’জন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেন। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কপোতাক্ষ কলেজ মাঠ থেকে হেলিকপ্টারে করে বিদায় নেন রাজকন্যা। এ সময় তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব, ইউএনডিপির এক্সটারনাল রিলেশনস ও অ্যাডভোকেসি পরিচালক উলরিকা মদির, সুইডেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা ও বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী ইয়োহান ফরশেল, বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার ও সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দ্রা বার্গ ফন লিন্ডে। এর আগে সকালে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) মো. ফিরোজ শাহ, পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) জয়দেব চৌধুরী, জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের ভিকেএসএ পাঞ্জুগাজী গিলাবাড়ি ইউনাইটেড একাডেমি মাঠের অস্থায়ী হেলিপ্যাডে ক্রাউন প্রিন্সেসকে স্বাগত জানান। চট্টগ্রামের জেলেপল্লি পরিদর্শন চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, সুইডেনের রাজকন্যা ভিক্টোরিয়া বিকেলে নগরীর মোহরা কালুরঘাট এলাকায় জেলেপল্লিতে ইউএনডিপির একটি প্রকল্প পরিদর্শন করেন এবং চট্টেশ্বরী রোডে এশিয়ান ওমেন ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মহানগরে তাঁর এ দুটি কর্মসূচির নিরাপত্তা এতটাই কড়াকড়ি করা হয়, নগরের টাইগারপাস, ওয়াসা, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, জিইসি মোড়সহ আশপাশের এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া কালুরঘাটে নদীতে ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। রাজকন্যা বরণে প্রস্তুত হাতিয়া হাত।