বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয় একমাত্র বাংলাদেশ
আসবাব বানানোর মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করা আবদুল জলিল এবং তাঁর স্ত্রী জুলেখা খাতুনের ছোট মেয়ে জয়নব খাতুন। কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার মণ্ডলপাড়ার এই জয়নবই বংশের একমাত্র সদস্য ছিলেন, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন। মেয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে চাকরি করবেন, সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তবে একটি দুর্ঘটনায় জয়নবের ঠিকানা এখন গ্রামটির কবরস্থান।
‘ভ্রমণকন্যা-ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের তত্ত্বাবধানে ৫৭ জনের একটি দল কেওক্রাডাং ভ্রমণে গিয়েছিল। দলে ৬০ বছর বয়সী নারী থেকে শুরু করে দুই শিশুও ছিল। ভ্রমণে সংগঠনটির রংপুর বিভাগের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জয়নবও ছিলেন।
পাঁচটি চাঁদের গাড়িতে (জিপগাড়ি) করে ভ্রমণকারীরা শুক্রবার বান্দরবান জেলা শহর থেকে বগা লেকে গিয়েছিলেন। শনিবার সকালে কেওক্রাডাং পাহাড়চূড়ায় ভ্রমণ শেষে একসঙ্গে ফিরে আসছিলেন। পাহাড়ি সড়ক দিয়ে নামার সময় একটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাহাড়ি খাদে পড়ে যায়। স্থানীয় লোকজন ও বেড়াতে আসা পর্যটকেরা মিলে প্রাথমিক উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করেন। পরে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সবাইকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রুমা-বগা লেক-কেওক্রাডাং সড়কের দার্জিলিংপাড়া ও রুমসংপাড়ার মাঝামাঝি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
জয়নব ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে ফিরোজা বেগম (৫৩) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়। ফিরোজা বেগম ছিলেন প্রথম আলোর সহসম্পাদক সজীব মিয়ার শাশুড়ি। সজীব মিয়ার স্ত্রী নুসরাত জাহান রিজভীও (৩০) এ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন। রিজভী হলেন সংগঠনটির কো-অর্ডিনেটর (সমন্বয়ক)।
ফেসবুকভিত্তিক দেশের নারীদের প্রথম ভ্রমণ সংগঠন ‘ভ্রমণকন্যা-ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’র বর্তমান সদস্য ৭৫ হাজারের বেশি নারী। ২০১৬ সালে চিকিৎসক মানসী সাহা ও সাকিয়া হকের হাত ধরে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। ভ্রমণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে সংগঠনটি।
আজ রোববার দুপুরে জয়নবের লাশ বাড়িতে নিয়ে যান তাঁর বড় ভাই মেহেদী হাসান। পরে গ্রামের কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। এর আগে জয়নবের লাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের সামনে নেওয়া হয়।
বিকেলে মোবাইলে কথা হয় মেহেদী হাসানের সঙ্গে। জয়নব খাতুন (২৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর বড় ভাই মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এবারের ঘোরা শেষ করে পড়াশোনায় মন দেবে, বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবে—এমনই কথা দিয়েছিল জয়নব। তবে এখন তো সব স্বপ্নই শেষ। বললেন, ‘টাকা শেষ হয়ে গেলে এখন আর কেউ বলবে না ভাইয়া টাকা পাঠাও। বোন বিসিএস দিয়ে বড় কর্মকর্তা হইছে, সে স্বপ্নও শেষ। বলতে গেলে সবার স্বপ্নই শেষ হইয়্য
মেহেদী হাসান জানালেন, তিনি নিজে এইচএসসির পর আর পড়াশোনা করেননি। টুকটাক কাজ করেন। তাঁর এক বোনের বিয়ে হয়েছে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন জয়নব। জয়নবই পরিবারের একমাত্র সদস্য, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
মেহেদী হাসান বলেন, ‘পরিবারের অবস্থা ভালো না। এরপরও নিজেদের খরচ বাঁচাইয়্যা বোনরে টাকা পাঠাইতাম। সবাই চাইতাম জয়নব ভালো থাকুক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর জয়নব টিউশনি করতে চাইছিল। বলছি, তুই পড়। টাকার ব্যবস্থা আমরা করব।’
দুর্ঘটনায় পড়া জিপগাড়িতে চালক ছাড়া জয়নব, ফিরোজা বেগমসহ পর্যটক ছিলেন ১২ জন। দুর্ঘটনার পরপরই চালক পালিয়ে গেছেন। ভ্রমণকন্যা-ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ সংগঠনটির পক্ষ থেকে ফেসবুকে জানানো হয়েছে, গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করার চেষ্টা চলছে। ৫৭ জন নারীকে নিয়ে বান্দরবান ভ্রমণ ছিল সংগঠনটির ২২৬তম ভ্রমণ। দুর্ঘটনার পর পরবর্তী সব ট্যুর বাতিল করা হয়েছে।
ঘটনার পর রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল হাছান প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ১৩ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনেন। দুজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়।
সংগঠনটির প্রতিনিধিরা জানালেন, ২২৬তম ট্যুরের মধ্যে এটিই ছিল প্রথম দুর্ঘটনা। সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবক বা মূল দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা মা, শাশুড়ি, ভাবিসহ পরিবারের সদস্যদের ট্যুরে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে ট্যুরের একটি গাড়ি ৫০০ মিটার খাদে পড়ে দুজনের মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সংগঠনটির পক্ষ থেকে আহত ব্যক্তিদের শারীরিক অবস্থা জানানো হচ্ছে। বিভিন্নজন জয়নবের মৃত্যু এবং এ দুর্ঘটনা নিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন।
ভ্রমণকন্যা-ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন চিকিৎসক সাকিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জয়নবকে খাদ থেকে তুলে আমার কোলে দেওয়া হয়। চিকিৎসক হিসেবে আমি দেখেই বুঝতে পারি, জয়নব আর নেই। এরপরও বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে দেখি। আর রিজভী নিচ থেকে ওপরে উঠে নিজেই বলেছে, মা তো আর নেই। এই যে যন্ত্রণা, তা আমাদের জীবনভর বয়ে বেড়াতে হবে। জয়নবের বয়স কম ছিল। ওর স্বপ্নেরা মাত্র ডানা মেলতে শুরু করেছিল। সব শেষ হয়ে গেল।’
ফিরোজা বেগম প্রসঙ্গে সাকিয়া হক বলেন, ‘রিজভী হলো আমাদের কো-অর্ডিনেটর। তাঁর মা ফিরোজা বেগম ছিলেন আমাদেরও মা। তিনি আমাদের সঙ্গে কত ভ্রমণে যে গিয়েছিলেন তার হিসাব নেই। হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। কেওক্রাডাংয়ে আমরা গ্রুপ ছবি তুললাম। অথচ এখন দুজন নাই হয়ে গেলেন। এ ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হবে না। গাড়িতে থাকা অন্যদের বাঁচানো সম্ভব হয়েছে, এটাই একমাত্র আশার কথা।’
সাকিয়া হক জানালেন, পর্যটকদের ৩৭ জনকে নিয়ে নুসরাত জাহান রিজভী ও জয়নব খাতুন তিনটি জিপে রওনা দিয়েছিলেন। তাঁদের বিদায় দিয়ে একটু যেতেই কয়েকজন দৌড়ে এসে জানান, একটি জিপ খাদে পড়ে গেছে। স্থানীয় জনগণ, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সবার তৎপরতায় দ্রুত উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব হয়। সাকিয়া হক সংগঠনের পক্ষ থেকে এ সময়ে যাঁরাই এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
সাকিয়া জানালেন, রুমাতে মাত্র একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার ছিলেন। তবে ৫৭ জনের দলটিতে তিনিসহ আরও কয়েকজন চিকিৎসক ছিলেন। কার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, সে অনুযায়ী অগ্রাধিকারভিত্তিতে চিকিৎসার আয়োজন করা হয়।
সাকিয়া হক বলেন, ‘আমি আমার শাশুড়িকে নিয়ে গিয়েছিলাম। রিজভী তাঁর মাকে নিয়ে যায়। আমাদের সংগঠনের আরেক সদস্য শান্তা নিজে না গেলেও তাঁর মা ছিলেন আমাদের সঙ্গে। দুর্ঘটনায় শান্তার মা গুরুতর আহত হয়েছেন। আর জয়নব তো নিজেই ছিল। রিজভীর এক ভাবি দুই সন্তানসহ ছিলেন। কেওক্রাডাংয়ে মাইলফলকের সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় রিজভীর মা মানে খালাম্মা হাত উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাদের কেউ একজন হাত সোজা করার কথা বলল। এই স্মৃতিগুলো কখনোই ভুলতে পারব না