নারীরা এখন কোথায় গেল?

নারীরা এখন কোথায় গেল?

জান্নাতুল জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি থেকে যখন তাঁরা গ্রাফিতি করার নির্দেশনা পেলেন তখন বরিশালে কাউকে পাচ্ছিলেন না। কোনো সংগঠন এগিয়ে আসেনি। তিনি ও আরেক নারী সহপাঠী এক চিত্রশিল্পীর কাছ থেকে বিনা মূল্য রংতুলি পান। ওই শিল্পী নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে নিজে গ্রাফিতি করতে রাজি ছিলেন না। এরপর পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতে তাঁরা দেয়ালে গ্রাফিতি করেন। আন্দোলনের সময় এক শিক্ষার্থীর বুক থেকে ২৩টি স্প্লিন্টার তুলেছিলেন হিজাবের পিন দিয়ে। তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশের ছোড়া চারটি কাঁদানে গ্যাসের শেলের দুটি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছেন। সেই দুটি ব্যাগ থেকে বের করে অনুষ্ঠানে দেখালেন। জান্নাতুল বলেন, আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নারীদের ‘মাইনাস’ করা শুরু হলো।

‘গণ–অভ্যুত্থানের নারীদের সংলাপ, নারীরা কোথায় গেল?’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো নারীদের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে
‘গণ–অভ্যুত্থানের নারীদের সংলাপ, নারীরা কোথায় গেল?’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো নারীদের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবেছবি: দীপু মালাকার

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় ১৫ জুলাই ভিসি চত্বরে গুরুতর আহত সামিয়া আক্তার জান্নাত বলেন, আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় বাড়ি এসে তাঁর মাকে অনেকে কটুকথা শুনিয়েছেন। মা–বাবা তাঁর পক্ষেই ছিলেন। বাকি সময় তিনি আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন মুখে কাপড় বেঁধে, যাতে কেউ তাঁকে চিনতে না পারে। রাষ্ট্রের এই সংস্কারের সময়ে নারীদের সমানভাবে কাজের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সামিয়া বলেন, ‘রাষ্ট্র কি (আন্দোলনে) দেখে নাই নারীদের! রাষ্ট্র হয়তো ডাক দেবে না আমাদের। আমরা নিজেরাই আসব।’

নোয়াখালীর শিক্ষার্থী সুমাইয়া রিশু বলেন, আন্দোলনের সময় নারী–পুরুষ কোনো ভেদাভেদ ছিল না। এখন অনেকেই আছেন দখলদারত্ব নিয়ে, নিজেদের তুলে ধরা নিয়ে। ঢাকার বাইরে যেসব নারী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের কোনো অবস্থানই নেই এখন। শুধু পুরুষদের জন্য না, এই আন্দোলন সফল হয়েছে ব্যাপকভাবে নারীদের অংশগ্রহণের কারণেই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের পদ–পদবি নয়, মানুষ হিসেবে সম্মান জানানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আন্দোলনে অনেক কৌশল করে, বাড়িতে মিথ্যা বলে, কোচিংয়ের কথা বলে, মায়ের পা ধরে সামাজিক ঘেরাটোপ ভেঙে নারীরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। আন্দোলনের পর ওই নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক হারে হয়রানির শিকার হন। সরকারকে বলার পর মনে হয়েছে, এটাকে তাঁরা বড় বিষয় মনে করেননি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন নাজিফা জান্নাত। তিনি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংলাপে তিনি বলেন, অনেক উদ্দীপনা নিয়ে নারীরা আন্দোলনে ছিলেন। এখন এসে সবাইকে যেন বোঝাতে হচ্ছে নারীরাও ছিল। এখন কোথাও নারীদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না বলে নিজেদের কথা জানাতে ফোরাম তৈরি করতে হচ্ছে।

‘গণ–অভ্যুত্থানের নারীদের সংলাপ, নারীরা কোথায় গেল?’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে সাহসিকতার গল্প শোনান কামরাঙ্গীরচরের ওয়াজউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী সামিয়া আক্তার জান্নাত। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে
‘গণ–অভ্যুত্থানের নারীদের সংলাপ, নারীরা কোথায় গেল?’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে সাহসিকতার গল্প শোনান কামরাঙ্গীরচরের ওয়াজউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী সামিয়া আক্তার জান্নাত। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবেছবি: দীপু মালাকার

নাজিফা জান্নাত বলেন, ‘প্রত্যেকে এসে জিজ্ঞাসা করেন, কেন আমাকে কম দেখা যাচ্ছে। তাঁরা আমাকে এমন একটা অনুভূতি দেন যে আমি “লেস” (কম সক্রিয় থাকা) ছিলাম। আমি “লেস” ছিলাম না, বরং আমাদের দেখা যাচ্ছে না কেন, সেই প্রশ্ন করা উচিত তাঁদেরকে, যাঁরা এখন রাজনৈতিক জায়গায় বা মন্ত্রণালয়ে বসেছেন। তাঁরা কেন নারীদের অন্তর্ভুক্ত করছেন না?’ নারী–পুরুষ কারও প্রতি বৈষম্য না রেখে সরকারের প্রতি কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সহায়তা ও মানসিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন অনেক নারী। তাঁরাও কথা বলেন সংলাপে। ধানমন্ডিতে বাসার গ্যারেজে ১০০–এর বেশি আহত শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া দুই চিকিৎসক অর্থী জুখরিফ ও হৃতিশা আক্তার এসেছিলেন। অর্থী জুখরিফ বলেন, ওই সময় অনেক শিক্ষার্থী ভবনগুলোর সামনে এসে পানির জন্য, আশ্রয়ের জন্য আকুলতা জানাতেন। কেউ দরজা খুলতেন না। এই দৃশ্য দেখে সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে বাসার গ্যারেজে তাঁরা চিকিৎসা দেন। ওই ভবনের বাসিন্দাদের যাঁর বাসায় যতখানি প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম ছিল, সবাই তা দিয়ে সহায়তা করেছিলেন তাঁদের।

চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ফারজানা সুলতানা জানান, তাঁরা বেশ কয়েকজন মিলে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা দিয়েছিলেন।

প্রবাসী নারীদের যাঁরা তহবিল সংগ্রহে ভূমিকা রাখেন, তাঁরাও সংলাপে অংশ নেন ভিডিও বার্তার মাধ্যমে। তেমন একজন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আসমা করিম বলেন, তাঁরা যে তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন, তার দাতাদের বেশির ভাগই ছিলেন নারী।

সংলাপে উপস্থিত হয়ে একই মন্তব্য করেন ভিশনারি ভয়েস নামের একটি সংগঠনের প্রতিনিধি ফারহানা শারমিন। তিনি বলেন, ৫টি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪৯ জনের চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য তাঁরা উদ্যোগী হন অভিভাবকের মনোভাব নিয়ে। সহায়তাদানকারীদের ৯০ শতাংশই ছিলেন নারী।

‘গণ–অভ্যুত্থানের নারীদের সংলাপ, নারীরা কোথায় গেল?’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে কথা বলেন ছাত্র–জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়া শ্রমজীবী নারী সামিনা ইয়াসমিন। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে
‘গণ–অভ্যুত্থানের নারীদের সংলাপ, নারীরা কোথায় গেল?’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে কথা বলেন ছাত্র–জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়া শ্রমজীবী নারী সামিনা ইয়াসমিন। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবেছবি: দীপু মালাকার

সংলাপে আরও বক্তব্য দেন উত্তরায় বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ নাঈমা সুলতানার (১৫) মা আইনুন নাহার, আন্দোলনে আহত প্রবীণ নারী মাসুরা বেগম, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শামীমা সুলতানা, আন্দোলনে অংশ নেওয়া শ্রমজীবী নারী সামিনা ইয়াসমিন, নরসিংদী সরকারি কলেজের শিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিন, ‘চব্বিশের উত্তরা’ সংগঠনের প্রতিনিধি সামিয়া রহমান প্রমুখ।

সংলাপে নারীদের বক্তব্য শোনার জন্য উপস্থিত ছিলেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান শিরীন হক, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মির্জা তাসলিমা সুলতানা।

সংলাপটি সঞ্চালনা করেন ‘লড়াকু ২৪’–এর সংগঠক কানিজ ফাতেমা মিথিলা এবং ‘এমপাওয়ারিং আওয়ার ফাইটার্স’–এর সংগঠক কলি