সাক্ষাৎকার : শারমীন মুরশিদ প্রথমে ঘরছাড়া, এর পর দেশছাড়া
সাক্ষাৎকার : শারমীন মুরশিদ
প্রথমে ঘরছাড়া, এর পর দেশছাড়া
নির্র্যবেক্ষক ও ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা মানুষটির রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। বহু মানুষের সান্নিধ্য তাঁকে করেছে ঋদ্ধ। সেসব অভিজ্ঞতা তিনি কথোপকথনে তুলে ধরেছেন
সমকাল: একাত্তরের ২৫ মার্চ আপনারা কোথায় ছিলেন?
শারমীন মুরশিদ: ২৫ মার্চ রাতে যখন অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলো, তখন ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চারপাশে চলছিল বীভৎস যুদ্ধযজ্ঞ। সারারাত ছিলাম বিছানার নিচে। জানালায় উঁকি দিতেও পারছিলাম না– তারা গুলি করতে পারে! দেখলাম, কী করে তারা জিপে রক্তাক্ত শার্ট পতাকার মতো উড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে– কেউ যেন ঘর থেকে বের না হয়। আমার মনে আছে, জানালায় উঁকি দিয়ে দেখছি, আমাদের পেছনের একটি বাড়িতে পাকিস্তানি সেনারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল; নিমেষে গুলির আওয়াজ। পরে জানতে পারলাম, তারা কিছু বাড়িতে মানুষ মেরেছে। মা-বাবা ধরেই নিয়েছিলেন, ক্র্যাকডাউন যখন হলো, সেনাবাহিনী যখন নেমে গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে গেছে, তখন যে কোনো মুহূর্তে তারা আমাদের বাসায় প্রবেশ করবে। আমরা রীতিমতো অপেক্ষমাণ। কিন্তু তারা আসেনি। ২৬ গেল। ২৭ মার্চ যখন কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ ভাঙল, বাবা বাসা থেকে বের হয়ে ছুটে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেসব মানুষ, যাদের সঙ্গে বছরের পর বছর একসঙ্গে কাজ করেছেন, তাদের এভাবে মেরে ফেলা হবে, তা কীভাবে তিনি মেনে নিতে পারেন! বাবা নিজেকে সংবরণ করতে পারছিলেন না। পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিলেন।
২৭ মার্চের রাত পার হওয়ার পর আমার মামা বাসায় এসে বললেন, এখনই চলো। তোমাদের ভীষণ বিপদ। আমি তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি। এর পর আমরা গ্রামের দিকে ছুটি; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। তবে সেখানেও নিরাপদ বোধ করেননি মা-বাবা। এক দিন পরই নৌকায় করে আমরা অন্য একটি গ্রামে যাই। গ্রামের নাম চাউরা। কিছুদিন পর সেখান থেকেও আমাদের সরে যেতে হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব কঠিন ছিল। বাবা দ্বিধায় ছিলেন। মা সিদ্ধান্ত নিলেন– আমাদের ওপারে চলে যেতে হবে। প্রথমে ঘরছাড়া হলাম, এর পর দেশছাড়া। যখন যাচ্ছি, তখন দেখলাম, আমার মা-বাবার চোখে পানি।
সীমান্ত পার হওয়ার সময় বাবা মাটি ছুঁয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আমরা সীমান্ত পার হলাম আগরতলা দিয়ে। শোভা মাসি (শোভা বসু) মায়ের সঙ্গে কলকাতায় পড়তেন। তিনি আমাদের জন্য যেন ফেরেশতা হয়ে আসেন। কিছুদিনের জন্য আমরা চার ভাইবোন আগরতলায় শোভা মাসির কাছে থেকে গেলাম। মা-বাবা বিমানে করে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে।
সমকাল: ওপারে কাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার?
শারমীন মুরশিদ: শোভা মাসির কাছে থাকা অবস্থায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়েছে। জায়গাটি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিশ্রামাগার হয়ে ওঠে। সেখানে কয়েক মাস থাকার সুযোগে অনেক যোদ্ধা এবং নিঃস্বার্থ যুবকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হুমায়ুন চৌধুরী, জাহানারা ইমামের ছেলে শাফী ইমাম (রুমী), সামাদ ভাই এবং আরও অনেকে ছিলেন। কেউ এক বেলা বিশ্রাম বা এক বেলা খাওয়ার জন্য আসতেন। এক বিকেলে দুটি সামরিক জিপ আমাদের দোরগোড়ায় এসে থামল। মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর খালেদ মোশাররফ ঘরে প্রবেশ করলেন। ততদিনে এ দু’জনের সাহস ও বীরত্বের কথা মানুষের মাঝে পৌঁছে গিয়েছিল।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আপনার কে অনুপ্রেরণা ছিলেন?
শারমীন মুরশিদ: আমার দাদা আলী আহমেদ খান বাংলা পর্ষদের পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন, মা নূরজাহান মুরশিদ যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় বাংলাদেশের প্রথম সরকারের দূত হিসেবে কাজ করেন। বাবা খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের জন্য অনেক কাজ করেছেন। পরিবারের এই রাজনৈতিক ও সমাজসচেতন আবহই আমাদের চার ভাইবোনকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রেরণা জোগায়।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন কীভাবে?
শারমীন মুরশিদ: একাত্তরে আমার বয়স ছিল অনেক কম; তখন কিশোরী। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি খুব পরিকল্পিত ছিল না। ছায়ানটের সন্জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হক ১৭৫ জনের একটি গানের দল করলেন। এই দলের লক্ষ্য হলো, শরণার্থী শিবিরে গান গাইবে, ক্যাম্পে গান গাইবে। মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের উদ্বুদ্ধ করবে। সেই সঙ্গে তহবিল গঠন করবে। আবৃত্তি, গান, নাচ; সব নিয়ে একটা রূপান্তরের গল্প তৈরি করা হলো– কেমন করে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের শোষণে পড়ল; কেমন করে যুদ্ধে গেল; এর পর যুদ্ধ জয়ের পর কেমন করে বাংলাদেশ তৈরি করছে। এ গল্পটা গান-কবিতা-নাচের মধ্য দিয়ে মঞ্চস্থ করতাম। এভাবেই আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ।
সমকাল: সে সময়ের কোনো বিশেষ স্মৃতি …
শারমীন মুরশিদ: যখন শিবিরে গান করতে যেতাম, তখন শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা হতো। তাদের সঙ্গে নিজেদেরও উদ্বুদ্ধ করতাম আশার বাণী শুনিয়ে। তবে অনেক অসহায় লাগত। কারণ, কেউ জানতাম না এর শেষ কোথায়।
আমাদের ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হতো না। এক দিন ট্রাক থামার পর দেখা গেল, কে যেন এক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে এসেছে। সেই মিষ্টি পেয়ে সবাই যে কী লাফালাফি করছিলাম! যেন জীবনে প্রথমবার মিষ্টি খাচ্ছি! তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রে ওই অংশটা আছে। এই চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধে গানের দলের কনট্রিবিউশন স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেছে। আরেকটা বিশেষ স্মৃতি, যখন মুক্ত এলাকায় গান করতে গেলাম, আমাদের পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে পা দিলাম। ওই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়!
সেটা ছিল উত্তরবঙ্গে। মেজর জিয়াউর রহমানের সেক্টরে। ওই এলাকার দায়িত্বে ছিলেন মেজর গিয়াস। এ জন্য অবশ্য ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিতে হয়েছিল