নিজস্ব প্রতিবেদক
২৭ বছর বয়সী নারী চিকিৎসক। বাবার নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করায় নিজের সিম দরকার হয়নি। ২০২৩ সালের নভেম্বরে নিজের নামে প্রথমবার সিম কিনতে গিয়ে হোঁচট খান! তার নামে সর্বোচ্চ সংখ্যক সিম থাকায় আর কোনো সিম নিতে পারবেন না।
কে বা কারা তার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) এবং আঙুলের ছাপ দিয়ে ১৫টি সিম নিয়েছে। তিনটি মোবাইল ফোন অপারেটরে এসব সিম নিবন্ধিত। অথচ তার আঙ্গুলের ছাপ জাতীয় পরিচয়পত্রের নিবন্ধন ছাড়া কোথাও দেননি তিনি। এই ভুক্তভোগীকে পরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিমগুলো ডিরেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন বাতিল) করতে হয়। তবে সবশেষ গত ২৫ মে গবেষণার কাজে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ঘটনার রহস্য এখনও উদঘাটন করা যায়নি এবং এ ধরনের ঘটনার অভিযোগ আর দ্বিতীয়টি এ যাবৎকালে পায়নি বিটিআরসি। দেশে এমন বহু ব্যতিক্রমী সাইবার অপরাধের ঘটনা ঘটছে বলে তথ্য উঠে এসেছে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিক্যাফ) গবেষণায়। সিক্যাফ ‘সাইবার অপরাধ প্রবণতা-২০২৪’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত এক বছরে দেশে দ্বিগুণ হারে বেড়ে এ ধরনের অপরাধ ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশে উঠে এসেছে। নতুন ধরনের অপরাধের মধ্যে রয়েছে- ইন্টারনেটে উন্মুক্তভাবে ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া, অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্রের অপব্যবহার, অনলাইন আয়ের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, নামী প্রতিষ্ঠানের নামে বিজ্ঞাপনের ফাঁদে প্রতারণা, অনলাইন জুয়া, ফোন নম্বর স্পুফিং ও স্ক্রিন মিররিং ইত্যাদি। আইনের আশ্রয় নিতে অনিহা আর সামাজিক লোক-লজ্জার ট্যাবুতে এসব অপরাধ থাকছে অন্তরালেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৭০ শতাংশ অপরাধ ঘটছে ব্যবহারকারীর অসচেতনতায়। তাই সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে ব্যাপকভাবে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির কোনো বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। শনিবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৪’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উদীয়মান প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে (সিক্যাফ) অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিক্যাফ উপদেষ্টা প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান। গবেষণা প্রতিবেদন পেশ করেন সিক্যাফ গবেষণা দলের প্রধান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ওবায়দুল্লাহ আল মারজুক। প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিটিআরসি’র মহাপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন) ব্রিগে. জে. কাজী মুস্তাফিজুর রহমান, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্নেন্স (জি.এস.জি) বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ এ. হুসেইন, বিশ্বব্যাংক এর পরামর্শক ও প্রধান গবেষক, আইডিয়া ফাউন্ডেশন হুসেইন সামাদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি’র কোষাধ্যক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজমুস সালিহিন এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ইশতিয়াক আহমেদ। সিক্যাফ সভাপতি কাজী মুস্তাফিজের সভাপত্বি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক নুরুন আশরাফী। অন্যান্যের মধ্যে সিক্যাফ সহ-সভাপতি এস এম ইমদাদুল হক এবং প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সম্পাদক আব্দুল মুনয়েম সৈকত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত সিক্যাফ সাইবার অপরাধ প্রবণতা—২০২৪ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে সাইবার অপরাধে যুক্ত হচ্ছে নতুন অপরাধ। এক বছরের ব্যবধানে এই হারটা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে মোট অপরাধের ১১.৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। পর পর দুই বছরের জরিপফল থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী সাইবার আক্রান্ত শিশুদের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৩.৬৫ শতাংশ। ভুক্তভোগীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৮.৭৮ শতাংশের বয়সই ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এছাড়াও আক্রান্তদের প্রায় ৫৯ শতাংশই নারী। অপরাধের ধরনের মধ্যে ২১.৬৫ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে অ্যাকাউন্ট বেদখলের (হ্যাকিং) শিকার হয়ে শীর্ষে রয়েছে। আর বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে দেশে সাইবারজগতে ‘পর্ণোগ্রাফি’ অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা বেড়েছে। ভুক্তভোগীদের ১১.৩৫ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন পর্ণোগ্রাফি। এছাড়াও ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৪৭.৭২ শতাংশ সামাজিক মর্যাদাহানী, ৪০.১৫ শতাংশ আর্থিক ক্ষতির শিকার, এবং প্রায় সবাই মানসিক যন্ত্রণায় কাতর ছিলেন। এদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮১.২৫ শতাংশ সাধারণ ডায়রি এবং ১৮.৭৫ শতাংশ লিখিত অভিযোগ করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগকারীদের মধ্যে ১২.৫০ শতাংশ মন্তব্য করেননি। ৮৭.৫০ শতাংশ সুফল পাননি। এসব প্রতারণায় আক্রান্তদের বেশিরভাগই শিক্ষিত। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ৪০.৯০ শতাংশ ভুক্তভোগী উচ্চ মাধ্যমিক পাস, ২১.২১ শতাংশ স্নাতক/সম্মান পাস, ১৬.৬৬ শতাংশ মাধ্যমিক পাস এবং ১২.৮৭ শতাংশ মাধ্যমিকের নিচে। স্ব-প্রণোদিত হয়ে ১৩২ জন ভুক্তভোগী অভিজ্ঞতা থেকে এই ফলাফল পেয়েছে সাইবার দেশের সাইবার জগতকে সুরক্ষিত রাখতে চায় দেশে এই খাতের স্বেচ্ছাসেবীদের অগ্রজ সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারেনস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ)। সংগঠনটি এজন্য কয়েকটি সুপারিশও দিয়েছে অনুষ্ঠানে। বিটিআরসি ডিজি কাজী মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যত সচেতনতা বাড়ানো যাবে ততই কমানো সম্ভব এই সাইবার অপরাধ। সচেতনতার দায়িত্ব সবাইকে সম্মিলিতভাবে পালন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। হুসেইন সামাদ বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হয়েছে। এখন এর দক্ষ ব্যবহার দরকার। কিন্তু দেশে ৭০ শতাংশই সাইবার আক্রমণ হচ্ছে ব্যক্তিসচেতনতার অভাবে। তাই সবার সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। মূল প্রবন্ধে মুশফিকুর রহমান বলেন, বিভিন্ন খাতে উদীয়মান প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য উন্নতি ও সুবিধা এনেছে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার স্পষ্ট উন্নতি, যোগাযোগ ও সংযোগের উন্নতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি এবং নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় অবদান। কৃষি ক্ষেত্রে উদীয়মান প্রযুক্তির ব্যবহার মানবসভ্যতাকে আরও অনেক মানবিক করে তুলবে। এই উন্নতির পাশাপাশি কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা সাবধানে বিবেচনা করার দাবি করে। এই উদ্বেগগুলির মধ্যে রয়েছে সম্ভাব্য গোপনীয়তা ও সুরক্ষা ঝুঁকি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি, প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি। উদীয়মান প্রযুক্তির সামাজিক সুবিধাগুলি সর্বাধিক করতে, একটি বহুমুখী পদ্ধতি প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে নাগরিকদের অধিকার ও গোপনীয়তা রক্ষা করে এমন নীতি ও বিধিমালা তৈরি করা। মুশফিক বলেন, পুনঃপ্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগের মাধ্যমে কর্মীদের দক্ষতা বিকাশকে উৎসাহিত করা জরুরি। উদীয়মান প্রযুক্তির যুগে জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনা সর্বোপরি হওয়া উচিত। এই লক্ষ্যে, দেশীয় শিক্ষাগত গবেষণা, শিল্প ক্ষেত্রে উদ্ভাবন এবং স্থানীয় সফ্টওয়্যার ও সমাধানের উন্নয়নকে উৎসাহিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতি কেবল প্রযুক্তি অর্জনে বিদেশি মুদ্রার ব্যয়ের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেবে না, বরং দেশীয়ভাবে তৈরি প্রযুক্তিগত সফ্টওয়্যার ও বিভিন্ন সলিউশনস রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন পথ খুলে দিয়ে জাতীয় উন্নতিতে অবদান রাখবে। নাজমুস সালেহিন বলেন, অনলাইন গ্যাম্বিলিংয়ের আড়ালে আছে মানিলন্ডারিং। তবে একে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোর ব্যাংকিং খাতে সহসাই একটি বিপদ আসছে। ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, চারটি ধারা ছাড়া সাইবার অপরাধ আইন ২০১৩ এর সব গুলো ধারাই হ্যাকিংয়ের আওতায় থাকলেও তা জামিনযোগ্য। এতে আমরা অনেক অপরাধীকেই শস্তির অধীনে আনতে সমস্যা হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা দেরিতে নালিশ করায় আইনের সুরক্ষা দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ছে। দেশে শিশু পর্ণো বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তা হচ্ছে। এটা শঙ্কাজনক। গবেষণা প্রতিবেদনে সুপারিশ: স্বল্পমেয়াদী: ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ইন্টারনেট ব্যবহারে ‘দেখা মাত্রই ক্লিক নয়, যাচাই ছাড়া শেয়ার নয়’- এই চর্চা অব্যাহত রাখা; ডিজিটাল লেনদেনে সতর্ক থাকা, যাতে প্রতারকের খপ্পরে পড়তে না হয়; কোথাও ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়ার আগে সেখানে সুরক্ষাব্যবস্থা বা এ সংক্রান্ত নীতিমালা আছে কি না যাচাই করে নেওয়া; অনলাইন কেনাকাটায় ডেলিভারিম্যানের উপস্থিতিতে প্যাকেজিং খুলে পণ্য মিলিয়ে নিন; ইন্টারনেটে যেকোনো পদক্ষেপে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন- বিষয়গুলো বিবেচনায় নিন। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারি সুনিশ্চিত করা; শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে সাইবার অপরাধ সেল গঠন করা যেতে পারে যেখানে শিক্ষার্থীরা নিঃসংকোচে অভিযোগ দিতে পারে এবং এর মাধ্যমেই আইনিব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা যায়; সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও সচেতনতা তৈরিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীজনের সমন্বয়। দীর্ঘমেয়াদী: প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক/সরকারি উদ্যোগ নিয়মিত জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীজনদের সমন্বয়; নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় জোর দেওয়া এবং সুরক্ষা লংঘন হলে তা শনাক্তে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিশ্চিত করা; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের উন্নত প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরি; প্রচলিত আইন সম্পর্কে নাগরিকদের জানানো; সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে; দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন ও প্রসারে টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ