শিবাজি পার্কে শেষকৃত্য, সুরলোকে পাড়ি জমালেন সুরের সরস্বতী

শিবাজি পার্কে শেষকৃত্য, সুরলোকে পাড়ি জমালেন সুরের সরস্বতী
শিবাজি পার্কে শেষকৃত্য, সুরলোকে পাড়ি জমালেন সুরের সরস্বতী

শিবাজি পার্কে শেষকৃত্য, সুরলোকে পাড়ি জমালেন সুরের সরস্বতী

মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে মানুষের ঢল। উপস্থিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু গভর্নরও উপস্থিত। ভারতের ক্রিকেট ঈশ্বর শচিন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খান, প্রখ্যাত গীতিকবি জাভেদ আখতার— কে নেই? শিবাজি পার্কই যেন এক টুকরো ভারত। অথচ সেখানে কারও মুখে হাসি নেই। কান্না লুকোতেই ব্যস্ত সবাই।

হবেই বা না কেন— এত মানুষের ঢল, এত আয়োজন— সবই যেন ভারতবাসীর হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে নেওয়া এক কিংবদন্তীকে বিদায় জানাতে। প্রায় সাত দশক ধরে কিন্নরী কণ্ঠে যে মানুষটি সুরের মায়াজাল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন কোটি মানুষকে, সেই সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরকেই যে শেষ বিদায়ের আয়োজন!

রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় শিবাজি পার্কে নেওয়া হয় ভারতের নাইটিঙ্গেলখ্যাত লতার মরদেহ। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভাই হৃদয় মঙ্গেশকর মুখাগ্নি করলেন। ইহলোক ছাড়িয়ে সুরলোকে পাড়ি জমালেন সুরের সরস্বতী লতা মঙ্গেশকর।

বিজ্ঞাপন
শিবাজি পার্কে শেষকৃত্য, সুরলোকে পাড়ি জমালেন সুরের সরস্বতী

শিবাজি পার্কে ভারতবাসীর প্রিয় ‘লতা দিদি’কে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছিলেন মহারাষ্ট্রের গভর্নর ভগত সিং কশ্যারি, মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধাব ঠাকরে, উপমুখ্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ার, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির প্রেসিডেন্ট শারদ পাওয়ারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

ওদিকে সুপারস্টার শাহরুখ খান, কিংবদন্তী গীতিকার জাভেদ আখতার, রণবীর কাপুর, রাজ ঠাকুর থেকে শুরু করে বলিউডের সব তারকারাও হাজির হয়েছিলেন গানে বলিউডকে সমৃদ্ধ করে যাওয়া সুরের কোকিলকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। ছিলেন শচিন টেন্ডুলকারের মতো তারকাও। এর বাইরে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের উপস্থিতি তো ছিলই।

শিবাজি পার্কে শেষকৃত্য, সুরলোকে পাড়ি জমালেন সুরের সরস্বতী
শিবাজি পার্কে লতার মরদেহ জাতীয় পতাকায় মুড়িয়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ উপস্থিত হতে না পারলেও তার তরফ থেকে জানানো হয় ফুলেল শ্রদ্ধা। এরপর শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপর ফুলে ফুলে ভরে ওঠে এই গানের পাখিকে বহন করা কফিন। পরে ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর মুখাগ্নিতে শেষ হয় লতা মঙ্গেশকরের ভূলোকযাত্রা, কণ্ঠের মায়াজাল দিয়ে যা তিনি অবিস্মরণীয় করে রেখে গেলেন।

এর আগে, রোববার সকালে ৯২ বছর বয়সে পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান লতা মঙ্গেশকর। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১১ জানুয়ারি থেকে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। হাসপাতালে গত প্রায় চার সপ্তাহে তার শারীরিক অবস্থার কখনো উন্নতি হয়েছে, কখনো অবনতি। রাখা হয় ভেন্টিলেশনে।

শিবাজি পার্কে শেষকৃত্য, সুরলোকে পাড়ি জমালেন সুরের সরস্বতী

সবশেষ শনিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) আরও এক দফায় শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। এবারে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে রোববার সকালে পৃথিবীর মায়া কাটালেন লতা।

প্রায় সাত দশক ধরে সুরের মায়াজালে শ্রোতাদের অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে তোলা লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে সংগীতাঙ্গনসহ গোটা ভারতেই নেমে এসেছে শোকের ছায়া। দেশটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ শোক জানিয়েছেন সবাই। বাংলাদেশেও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক জানিয়েছেন এই সুরসম্রাজ্ঞীর প্রয়াণে। শোক জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও।

শিবাজি পার্কে শেষকৃত্য, সুরলোকে পাড়ি জমালেন সুরের সরস্বতী

সুরের একজীবন

১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এক মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লতা মঙ্গেশকর। বাবা অভিনেতা ও গায়ক পন্ডিত দিননাথ মঙ্গেশকর, মা শেবন্তি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। তবে এর আগেই বাবার হাত ধরে তার  সংগীতের হাতেখড়ি শৈশবেই। প্লেব্যাকের যাত্রা শুরু ১৯৪২ সালে, মারাঠি একটি ছবিতে। তবে জনপ্রিয়তা পেতে অপেক্ষা করতে হয় আরও প্রায় সাত বছর। ১৯৪৯ সালে মহল ছবিতে গেয়েছিলেন ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। সেই শুরু, এরপর তার কণ্ঠ থেকে কেবলই ঝরেছে মাধুর্যের সম্ভার। কালে কালে হয়ে উঠেছেন ভারতীয় উপমহাদেশের সুরসম্রাজ্ঞী।

লতা ছিলেন মারাঠি ভাষাভাষী। কিন্তু সুরের ভুবনে তিনি যেন সত্যিই সরস্বতী। হিন্দি, বাংলা, উর্দু থেকে শুরু করে ৩৬টি ভাষায় গেয়েছেন গান। মুকেশ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, এস ডি বর্মণ, আর ডি বর্মণ, সলিল চৌধুরী থেকে প্রথিতযশা সব সংগীত পরিচালকের কাছেই লতা ছিলেন এক পরম নির্ভরতার নাম। তাদের সুর-সংগীতে একের পর এক কালজয়ী গান কণ্ঠে তুলে উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের। মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মান্না দে থেকে শুরু করে উদিত নারায়ণ, সনু নিগামের মতো শিল্পীদের সঙ্গেও রয়েছে তার অসংখ্য জনপ্রিয় সব গান।

শিবাজি পার্কে শেষকৃত্য, সুরলোকে পাড়ি জমালেন সুরের সরস্বতী

ভারতীয় সংগীতের ধারা বদলের অন্যতম রূপকার লতা মঙ্গেশকর তার কিন্নর কণ্ঠ নতুন মাত্রা দিয়েছেন আধুনিক ও প্লেব্যাক সংগীতে। বর্ণিল ক্যারিয়ারে বলিউড মাতিয়ে একটা সময় সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা গানকেও। ও মোর ময়না গো, যা রে.. যা রে উড়ে যা রে পাখি, আমি যে কে তোমার, কী লিখি তোমায়, আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন, প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, সাত ভাই চম্পা জাগো— এমন প্রায় দুইশ হৃদয় ছোঁয়া গান দিয়ে বাংলা গানের ইতিহাসেও অমর হয়ে রয়েছেন লতা।

শ্রোতাদের ভালোবাসা যেমন, লতার অর্জনের খাতায় তেমনই রয়েছে অসংখ্য পুরস্কার আর সম্মাননা। ২০০১ সালে তিনি ভূষিত হন ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ভারতরত্নে। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার দেয় তাকে সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাব। আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন বহু প্রতিষ্ঠান থেকে। পেয়েছেন তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার।

সলিল চৌধুরীর কথা-সুরে মায়াবি কণ্ঠের জাদুতে লতা গেয়েছিলেন অবিস্মরণীয় গান— ‘ফুরালো প্রাণের মেলা/ শেষ হয়ে এলো বেলা/ আর কেন মিছে তোরে বেঁধে রাখি?’ এই কোকিলকণ্ঠীর সুরের জাদুও বুঝি শেষ হলো ৯২ বছর বয়সে। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে লতা গেলেন হয়তো ইন্দ্রলোকে। যা রেখে গেলেন,