কেন পাল্টাপাল্টি হামলা চালাচ্ছে ইরান ও পাকিস্তান, এরপর কি হবে
কেন পাল্টাপাল্টি হামলা চালাচ্ছে ইরান ও পাকিস্তান, এরপর কি হবে
একে অপরের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে ইরান ও পাকিস্তান। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে এমন বৈরী পরিস্থিতির নজির নেই। বিশেষ করে এমন সময়ে এ ঘটনা ঘটল, যখন ফিলিস্তিনের গাজায় সংঘাত ঘিরে মধ্যপ্রাচ্য—এমনকি এ অঞ্চলের বাইরেও দ্রুত উত্তেজনা বাড়ছে।
পাল্টাপাল্টি এ হামলার শুরু গত মঙ্গলবার। ইসলামাবাদের অভিযোগ, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে হামলা চালিয়েছে ইরান। এতে দুই শিশুসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। তবে তেহরানের দাবি, তারা পাকিস্তানি ভূখণ্ডে শুধু ইরানি ‘সন্ত্রাসীদের’ ওপর হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের কোনো নাগরিককে লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি।
তবে ইরান যা–ই বলুক না কেন, ওই হামলায় ক্ষুব্ধ হয় পাকিস্তান। দেশটির কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, ওই হামলা ‘পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।’
ইরানে যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে, সেগুলোর একটি জইশ আল-আদল। এটি প্রকৃতপক্ষে জুনদাল্লাহ নামের একটি সুন্নি সশস্ত্র গোষ্ঠীর অংশ ছিল।
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাসনিমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জইশ আল-আদল নামে একটি সুন্নি সশস্ত্র গোষ্ঠীর ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে তেহরান। এই গোষ্ঠী জইশ আল-ধুলম বা ‘ন্যায়বিচারের বাহিনী’ নামে ইরানে পরিচিত।
জইশ আল-আদল ইরান ও পাকিস্তানে সক্রিয়। এর আগে ইরানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দায় স্বীকার করেছে তারা। এই গোষ্ঠীর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের স্বাধীনতা।
ইরানের হামলার এক দিন বাদে বৃহস্পতিবার পাল্টা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদ বলছে, সিস্তান-বেলুচিস্তানে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিভিন্ন আস্তানায় হামলা চালানো হয়েছে। এরপর তেহরান জানিয়েছে, ওই হামলায় অন্তত নয়জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিন নারী ও চার শিশু রয়েছে।
পাকিস্তান জানিয়েছে, ইরান পাকিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধাদের ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ পরিণত হয়েছে বলে কয়েক বছর ধরে অভিযোগ করে আসছে ইসলামাবাদ। ওই যোদ্ধাদের দমনে বাধ্য হয়েই এই হামলা চালানো হয়েছে।
এখন কেন হামলা
সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা ঠেকাতে ইরান ও পাকিস্তানের প্রচেষ্টা নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে সীমান্তে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। গত মাসেই সিস্তান-বেলুচিস্তানে একটি পুলিশ কার্যালয়ে জইশ আল-আদলের যোদ্ধারা হামলা চালান বলে অভিযোগ তেহরানের। ওই হামলায় ইরানের ১১ পুলিশ সদস্য নিহত হন।
মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবারের হামলায় অস্বাভাবিক বিষয়টি হলো, পাকিস্তান ও ইরান—দুই পক্ষই একে অপরকে না জানিয়ে সীমান্তের ওপারের ‘সন্ত্রাসী’ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। আর এটা এমন সময় ঘটল, যখন গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এ নিয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল এখন উত্তাল।
পাকিস্তান–ইরান সংঘাত অর্থনীতিতে যে প্রভাব ফেলতে পারে
মঙ্গলবারের হামলার পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসেইন আমির আবদোল্লাহিয়ান পাকিস্তানকে ‘বন্ধুত্বসুলভ দেশ’ অভিহিত করেছিলেন।
পাকিস্তানের হামলার আগে ইরাক ও সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। দেশটির দাবি, জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও ইসলায়েলের গুপ্তচরদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ওই হামলা চালানো হয়েছে। এদিকে গাজা সংঘাত শুরু হওয়ার পর ইসরায়েল ও লেবাননের ইরানপন্থী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মধ্যে পাল্টাপাল্টি সংঘাত চলছে। আর লোহিত সাগরে কয়েকটি জাহাজে ইরানপন্থী ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতিদের হামলার পর দেশটিতে গোষ্ঠীটির বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস–এর গবেষক করিম সাদজাদপুর বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছে ইরান।
এ অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা থেকে সুবিধা নিতে চায় তেহরান। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা পূরণ করতে চায় তারা। ইরান এখন যেসব মূল লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে, তার মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনিদের ক্ষমতায়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ঠেকানো।
বিভিন্ন দেশে হামলার মধ্য দিয়ে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক। তিনি বলেন, ইরান মধ্যপ্রাচ্যে অধিপত্য সৃষ্টি করতে চাইছে। আর এ অঞ্চলে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের তৎপরতা রয়েছে, তখন পাল্টা হামলা চালানো এবং নিজেকে জাহির করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে তেহরান।
ইরানের হামলার পর আতঙ্কের জনপদ পাকিস্তানের গ্রাম
বালুচ অঞ্চল অশান্ত কেন
বালুচ জনগোষ্ঠীর লোকজন পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানে বসবাস করে। তবে তেহরান ও ইসলামাবাদের শাসনের অধীনে থাকতে তারা রাজি নয়। দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীনতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দশকের পর দশক ধরে ইরান ও পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলজুড়ে তাদের বিদ্রোহী তৎপরতা চলছে।
এই অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদেও সমৃদ্ধ। তবে বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভিযোগ, এই সম্পদ থেকে খুব কম সুবিধা পায় তারা। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চায় তারা। ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তানে সশস্ত্র গোষ্ঠী জইশ আল-আদলের দাবিও একই। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে কুর্দি ও আরব সংখ্যালঘুদের বিদ্রোহের মুখেও পড়ছে তেহরান।
ইরানে যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী তৎপর, তার মধ্যে একটি জইশ আল-আদল। এটি প্রকৃতপক্ষে জুনদাল্লাহ নামের একটি সুন্নি সশস্ত্র গোষ্ঠীর অংশ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে জইশ আল-আদলের এক নেতাকে ইরান মৃত্যুদণ্ড দিলে তারা জুনদাল্লাহ থেকে আলাদা হয়ে যায়। বর্তমানে গোষ্ঠীটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় রয়েছে।
২০১৫ সালে ইরানের আট সীমান্তরক্ষীকে হত্যার দায় স্বীকার করে জইশ আল-আদল। ২০১৯ সালে সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে ইরানের সেনাবাহিনীর সদস্যদের বহনকারী একটি বাসে আত্মঘাতী হামলা হয়। এতে অন্তত ২৩ জন নিহত হয়েছিলেন। ওই হামলায় দায়ও স্বীকার করেছিল জইশ আল-আদল।
এদিকে মঙ্গলবার পাকিস্তানে জইশ আল-আদলের লক্ষ্যবস্তুতে ইরানের হামলার পর বুধবার সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে ইরানি সামরিক বাহিনীর একটি যানে হামলার দায় স্বীকার করেছে গোষ্ঠীটি।
ইরান-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি হামলায় উত্তেজনা চরমে
এরপর কী
পাল্টাপাল্টি হামলা ছাড়াও কূটনৈতিক পদক্ষেপও নিয়েছে দুই দেশ। পাকিস্তানে নিয়োজিত ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের পাশাপাশি তেহরান থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়েছে ইসলামাবাদ। প্রতিবেশী দেশটিতে উচ্চপর্যায়ের সব সফরও স্থগিত করা হয়েছে। এদিকে পাকিস্তানের হামলার পর বৃহস্পতিবার তেহরানে পাকিস্তানি দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করা হয়েছে।
হামলা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন দেশও। ভারত বলেছে, ‘সন্ত্রাসবাদের বিষয়টি একদম বরদাশত করবে না তারা।’ আর এই হামলা ‘পাকিস্তান ও ইরানের নিজেদের বিষয়।’ চীন দুই দেশকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে সংকট ঠেকাতে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবও দিয়েছে বেইজিং