হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন।
১০০ বছর বয়সে মারা গেছেন হেনরি কিসিঞ্জার। গত শতকে মার্কিন কূটনীতির অনেক অঘটনের নায়ক যে লোকটি, তাঁকে কীভাবে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে, সে ব্যাপারে কোনো মতৈক্য নেই। কারও চোখে তিনি বাস্তববাদী সফল কূটনীতিক। ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসানে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিজমকে ঠেকাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি একজন ‘টাইটান’।
অন্যরা বলবেন ঠিক অন্য কথা। নিজের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সাফল্য অর্জনে তিনি এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে লক্ষই করেননি, তাঁর প্রস্তাবিত নীতির কারণে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কমিউনিজম ঠেকাতে গিয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সর্বনাশ করছেন। তাঁদের চোখে কিসিঞ্জার একজন ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির মহিরুহ হতে পারেন, কিন্তু তাঁর হাতে রয়েছে নিহত লাখো মানুষের রক্তের দাগ। এই অপরাধের জন্য তিনি কখনোই মনস্তাপ করেননি।
কিসিঞ্জারের প্রতি এই দুই পরস্পরবিরোধী মনোভাব—একদিকে তাঁর সাফল্যের বন্দনা, অন্যদিকে কঠোর সমালোচনা—এর সেরা উদাহরণ ১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। যে ভিয়েতনাম যুদ্ধ তিন বছর আগেই বন্ধ করা যেত, কিন্তু রাজনৈতিক ফায়দার জন্য যা তিনি জিইয়ে রাখলেন, তারই জন্য নোবেল পুরস্কার? পৃথিবীজুড়ে এর তীব্র প্রতিবাদ উঠেছিল। কিসিঞ্জার নিজে যে এই পুরস্কারের জন্য খুব গর্বিত ছিলেন, তা নয়। বস্তুত সমালোচনা ও বিক্ষোভের ভয়ে সে পুরস্কার নিতেই আসেননি। নোবেল কমিটিরই দুজন সদস্য তাঁর মনোনয়নের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন
কিসিঞ্জারের বিচারের দাবি
যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কিসিঞ্জারকে যাঁরা বিচারের কাঠগড়ায় তোলার দাবি তুলেছেন, ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্স তাঁদের অন্যতম। ২০০১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ছয়টি অভিযোগ তোলেন।
১. ষাট ও সত্তরের দশকে ইন্দোচীনে নিরপরাধ নাগরিকদের সুপরিকল্পিত হত্যায় মদদ।
২. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যায় সমর্থন ও সাহায্য।
৩. ১৯৭৩ সালে চিলির সামরিক অভ্যুত্থান ও বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন।
৪. সাইপ্রাসের আর্চবিশপ ম্যাকারিয়সের হত্যা পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ।
৫. পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনীর হাতে গণহত্যায় সাহায্যদান।
৬. ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থানরত একজন সাংবাদিক হত্যায় ভূমিকা।
নৈতিকতা বনাম জাতীয় স্বার্থ
কিসিঞ্জার বরাবর নিজের ভূমিকা জাতীয় স্বার্থের নিরিখে বিচারের কথা বলেছেন। মার্কিন অনুসৃত নীতির কারণে মৃত্যু ও ধ্বংস হয়েছে, এ কথা তিনি স্বীকার করেছেন; কিন্তু তাঁর যুক্তি হলো, ‘জন্ম মানেই মৃত্যু, জীবন মানেই যন্ত্রণা।’এই কূটনীতি, তাঁর ভাষায়, রিয়েল পলিটিক।
যে একদর্শী নীতির ভিত্তিতে এই ‘বাস্তববাদী কূটনীতি’ পরিচালিত, তার কেন্দ্রে ছিল এই বিশ্বাস যে যেকোনো মূল্যে বিজয় অর্জন করতে হবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি নিজে লিখেছেন, ‘একজন রাষ্ট্রনায়ককে মূল্যবোধ ও প্রয়োজনের মধ্যে একটি ভারসাম্য অর্জন করতে হবে। হতে পারে যে সমাধান তিনি বেছে নিলেন, তা ত্রুটিমুক্ত নয়; কিন্তু নিজ দায়িত্বের সামনে তিনি পিছপা হতে পারেন না।’
সোজা কথায়, হোক ধ্বংস, হোক মানবাধিকারের লঙ্ঘন, নিজের স্বার্থ উদ্ধারে ভালো-মন্দের বাছবিচার অবান্তর। ঠিক এই যুক্তিতেই তিনি উত্তর ভিয়েতনামী নেতৃত্বকে কাবু করার জন্য চীন ও ভিয়েতনামের মধ্যে রেলযোগাযোগ-ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের নিশ্চিত পরাজয় ঠেকাতে তিনি প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে ফোন করে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছিলেন। একই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়। তাঁরই পরামর্শে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
নিরেট, নিষ্ঠুর ও বর্বর শক্তি প্রয়োগের যে বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নে কিসিঞ্জার নেতৃত্ব দেন, আজও যুক্তরাষ্ট্র সেই নীতিমালা অনুসরণ করে চলেছে। ঐতিহাসিক গ্রেগ গ্রানডিন কিসিঞ্জারের রাজনৈতিক জীবনী গ্রন্থ ‘কিসিঞ্জার’স শ্যাডো’তে লিখেছেন, ‘আমেরিকা এখনো যে একের পর এক বিরামহীন যুদ্ধে লিপ্ত, সেটাই কিসিঞ্জারের আসল লিগেসি বা উত্তরাধিকার।’
ভিয়েতনাম যুদ্ধ বাধানো
মার্কিন রাজনীতিতে কিসিঞ্জারের আবির্ভাব ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগেভাগে। সে সময় পেছন দরজা দিয়ে তিনি রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছিলেন। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জনসন আগ্রহী ছিলেন আলোচনার মাধ্যমে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান হোক। সেই লক্ষ্যে ভিয়েতকং নেতৃত্বের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছিল।
সে আলোচনা ঠেকানো না গেলে নিক্সন তাঁর ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী হামফ্রের কাছে পরাজিত হবেন। তাই কিসিঞ্জারের পরামর্শ ছিল, যেভাবে হোক, যুদ্ধটা জিইয়ে রাখুন। সে পরামর্শ শুনে নিক্সন গোপনে দক্ষিণ ভিয়েতনামীদের কাছে বার্তা পাঠান, নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধটা চালিয়ে যাও। সে কথা জানার পর প্রেসিডেন্ট জনসন নিক্সনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ এনেছিলেন, কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর নিক্সন কিসিঞ্জারকে তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। কিসিঞ্জারের প্রথম কাজ ছিল, যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে ভিয়েতনামী নেতৃত্বের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু। কিন্তু সে কাজে চাপ সৃষ্টির জন্য তাঁর পরামর্শে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র কম্বোডিয়ার ওপর লাগাতার বোমাবর্ষণ শুরু করে। বিস্ময়ের কথা হলো, কম্বোডিয়ার সঙ্গে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের আদৌ কোনো বিবাদ ছিল না। শুধু নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য অরক্ষিত দেশটিকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে কাজে লাগানো হয়। এই বোমাবাজির কারণে কমপক্ষে এক লাখ কম্বোডিয়াবাসীর মৃত্যু হয়।
পূর্ব তিমুরে গণহত্যা
পূর্ব তিমুরে গণহত্যার পেছনেও কিসিঞ্জারের ভূমিকা রয়েছে। অতি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডটি ইন্দোনেশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়ছিল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সে লড়াই প্রবল আকার ধারণ করে।
কিসিঞ্জার ধরে নিয়েছিলেন, দেশটি স্বাধীন হয়ে গেলে সেটি কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে যাবে। অতএব যেকোনো মূল্যে তা ঠেকাতে হবে। ১৯৭৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার সামরিক শাসক জেনারেল সুহার্তোকে এক ব্যক্তিগত বৈঠকে তিনি পরামর্শ দেন, যা করা দরকার তা করতে হবে। সময় ক্ষেপণের প্রয়োজন নেই। আমেরিকা তাদের পাশে থাকবে।
কংগ্রেসের নির্দেশ অমান্য করে পাঠানো মার্কিন সামরিক সাহায্য তিমুরিদের গণহত্যায় ব্যবহৃত হয়। সে যুদ্ধে দুই লাখের মতো পূর্ব তিমুরবাসী নিহত হন।
চিলিতে রক্তাক্ত অভ্যুত্থান
১৯৭৩ সালে চিলিতে সালভাদোর আইয়েন্দের বামপন্থী সরকার উৎখাতের ব্যাপারে যে কিসিঞ্জার ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলেন, তার বিস্তর তথ্য-প্রমাণ সম্প্রতি অবমুক্ত নথিপত্রে রয়েছে। কিসিঞ্জারই নিক্সনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, বামপন্থী আইয়েন্দেকে সরাতেই হবে। অন্যথায় কমিউনিজমের বীজ লাতিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়বে।
সিআইএর প্রধান রিচার্ড হেল্মসকে ডেকে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, চিলিকে কিছুতেই কমিউনিস্টদের কাছে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সিআইএর পরিচালনায় ও কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত নির্দেশনায় সে বছর সেপ্টেম্বরে এক রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানে আইয়েন্দেকে সরিয়ে জেনারেল পিনোশেকে ক্ষমতায় বসানো হয়।
বিল ক্লিনটন মন্ত্রিসভার সাবেক শ্রমমন্ত্রী রবার্ট রাইস লিখেছেন, কিসিঞ্জার চিলির গণহত্যার নীলনকশার প্রণেতা। তিনি শুধু আইয়েন্দেকেই নয়, চিলির গণতন্ত্রকেও হত্যা করেছেন। এই অপরাধের জন্য যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়, চিলির মানুষকে এখনো তা বহন করে চলতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও কিসিঞ্জার
নিজের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে কিসিঞ্জার কত দূর যেতে প্রস্তুত ছিলেন, তার এক বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়েছে, এ তথ্য কিসিঞ্জারের অজানা ছিল না। তখন তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে সহকারী। উইলিয়াম রজার্স পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও পররাষ্ট্রবিষয়ক অধিকাংশ প্রশ্নে তিনিই ছিলেন নিক্সনের মন্ত্রণাদাতা।
২৮ মার্চ ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এক টেলিগ্রামে হোয়াইট হাউসকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ‘ভীতির রাজত্ব’ কায়েম হয়েছে বলে যে সতর্কবার্তা পাঠান, পরদিন সকালেই সে তথ্য তাঁর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। একদিন পর দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং ‘নির্বাচিত গণহত্যা’ এই শিরোনামে এক টেলিগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহকৃত অস্ত্র দিয়ে নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে জড়িত, এ কথা জানিয়ে অনুরোধ রাখলেন, ‘নীতির ভিত্তিতে কর্মপন্থা নির্ধারণের এখনই সময়’। এক সপ্তাহ পর, ৬ এপ্রিল, ঢাকা থেকে ২১ জন মার্কিন কূটনীতিক এক যৌথ টেলিগ্রামে বাংলাদেশে গণহত্যায় মার্কিন নীরবতায় তাঁদের ‘ভিন্নমত’ জানিয়ে এক কঠোর বার্তা পাঠালেন। স্বাক্ষরকারীদের একজন ছিলেন আর্চার ব্লাড।
তাঁরা পাকিস্তানের পক্ষেই থাকবেন, বাঙালিদের নয়—নিক্সন ও কিসিঞ্জার এ সিদ্ধান্ত এক বছর আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৭০ সালের ২৫ অক্টোবর হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি এক বৈঠকে সে সিদ্ধান্ত তাঁরা নেন। ‘আপনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব,’ নিক্সন তাঁকে জানিয়েছিলেন। জবাবে ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘আপনাদের বন্ধুত্বের জন্য আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। কথা দিচ্ছি, এমন কিছুই করব না, যাতে আপনারা বিব্রত হন।’
পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে, সেনা মোতায়েন হচ্ছে, এ কথা কিসিঞ্জার খুব ভালো করেই জানতেন। ১৩ মার্চ নিক্সনের কাছে এক মেমোতে তিনি পরামর্শ দিলেন, ‘এখন এমন কিছুই আমরা করব না, যা ইয়াহিয়া আপত্তিজনক মনে করেন। পাকিস্তানের ঐক্যের স্বার্থে আমাদের উচিত ইয়াহিয়ার সঙ্গে থাকা।’
ঢাকা থেকে সামরিক অভিযানের খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার বদলে খুশিই হলেন কিসিঞ্জার। ২৯ মার্চ নিক্সনকে জানালেন, মনে হয় ইয়াহিয়ার গৃহীত ব্যবস্থায় কাজ হয়েছে। ‘পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা এখন ইয়াহিয়ার নিয়ন্ত্রণে।’ সে কথা শুনে নিক্সনের জবাব ছিল, ‘চমৎকার। মাঝেমধ্যে শক্তির ব্যবহার কাজে লাগে।’ সে কথায় মাথা নাড়লেন কিসিঞ্জার।
ইতিমধ্যে ঢাকায় পাকিস্তানিদের হাতে গণহত্যার খবর পত্রপত্রিকার প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিক্সন প্রশাসনের ওপর প্রবল চাপ বাড়ছিল। কিন্তু কিসিঞ্জার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি কথা বলতেও প্রস্তুত ছিলেন না। ১৯ এপ্রিল এক মেমোতে তিনি লিখলেন, পাকিস্তানের প্রতি সাহায্য বন্ধের যে দাবি উঠেছে, তিনি তার বিরুদ্ধে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভেতরেই তাঁর কথার প্রতিবাদ উঠল, নৈতিক কারণে হলেও পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড বন্ধে ইয়াহিয়াকে উৎসাহ দেওয়ার দাবি করলেন বিভাগীয় কর্মকর্তারা। সব বাতিল করে দিলেন কিসিঞ্জার। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তাঁর যুক্তি ছিল, এর ফলে ভারতকে সাহায্য করা হবে। সে কথার সমালোচনা হলে কিসিঞ্জার নতুন পথ ধরলেন। বললেন, এই নীতি আমার নয়, প্রেসিডেন্টের। জানালেন, পাকিস্তান, বিশেষত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জন্য নিক্সনের ‘কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে’।
পাকিস্তানের প্রতি কেন এই দুর্বলতা, পাকিস্তানের সামরিক শাসকের সঙ্গে কী বিশেষ সম্পর্ক—সে কথা তখনো অনেকের অজানা। জুলাই মাসের মাঝামাঝি জানা গেল, পাকিস্তানের সামরিক শাসকের মধ্যস্থতায় চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চলছে।
নিজের স্মৃতিকথায় কিসিঞ্জার যুক্তি দেখিয়েছেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন আমেরিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আর সে সম্পর্ক স্থাপনে ‘একমাত্র’ সূত্র ছিল পাকিস্তানের ইয়াহিয়া। কথাটা মিথ্যা। সে সময় স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা ছিলেন ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন। পরে এক দীর্ঘ প্রবন্ধে তিনি প্রমাণ করেছেন, শুধু ইয়াহিয়া নয়, রোমানিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান চশেস্কু, ইরানের শাহ ও পোল্যান্ডের মাধ্যমে সেই যোগাযোগের সুযোগ ছিল। বস্তুত ইয়াহিয়ার আগে চশেস্কুর মাধ্যমে চীনা নেতাদের সম্মতিসূচক চিঠি এসে পৌঁছেছিল।
ভ্যান হলেন লিখেছেন, কিসিঞ্জার পিকিং ঘুরে এসেছেন এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে—এই ঘোষণার পর স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, পাকিস্তানের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এবার হয়তো আমেরিকা পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার ব্যাপারে নীতি বদলাবে। কিসিঞ্জার তাতেও আপত্তি করেন। এবার তাঁর নতুন মন্ত্র হলো, ভারত শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বিভক্তি নয়, পাকিস্তান আক্রমণ করে দেশটি দখল করতে চায়।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এতে ইন্ধন জোগাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভ্যান হলেন জানাচ্ছেন, সিআইএ এবং অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কেউই এই তথ্য দেয়নি। ভারত পাকিস্তান দখলে উদ্যত, এমন কথাও কোনো পক্ষ থেকেই বলা হয়নি। সবটাই কিসিঞ্জারের মনগড়া।
৩১ জুলাই জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সভায় দাবি উঠল, ইয়াহিয়াকে বলা হোক, তিনি যেন পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক দায়দায়িত্ব থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে আনেন। সে কথা শুনে খেপে উঠলেন তিনি, ‘ইয়াহিয়া কীভাবে দেশ চালাবেন, তা নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন?’ তিনি প্রশ্ন করলেন। সেই সভাতেই কিসিঞ্জার জানালেন, আমেরিকার নীতি যাতে পাকিস্তানের পক্ষে থাকে, নিক্সন তাঁকে সে ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন।
ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সিআইএ জানায়, আজাদ কাশ্মীর দখলে ভারত বদ্ধপরিকর। সেই প্রতিবেদনকেই কিসিঞ্জার ভারতের পাকিস্তান দখলের অকাট্য প্রমাণ বলে ধরে নেন। যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে—এই বিবেচনা থেকে তিনি চীনকে চাপ দিতে শুরু করলেন, যাতে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে সে সৈন্য মোতায়েন করে। নিউইয়র্কে এক গোপন বৈঠকে কিসিঞ্জার চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়াকে অনুরোধ করলেন, সরাসরি যুদ্ধ শুরু করতে হবে না। শুধু সীমান্তে চীনা সৈন্য মোতায়েন করলেই ভারত ভয় পেয়ে আত্মরক্ষার খাতিরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে আনতে বাধ্য হবে। এর ফলে ইয়াহিয়ার ওপর চাপ কমবে।
তারপরও চীন ও ভারতের মধ্যে যদি সামরিক সংঘর্ষ বেধেই যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পাশে থাকবে, হুয়াকে প্রতিশ্রুতি দিলেন কিসিঞ্জার। পরে এক সাক্ষাৎকারে নিক্সন স্বীকার করেন, ১৯৭১ সালে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ শুরু হলে তিনি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে দ্বিধা করতেন না।
কিসিঞ্জারের কথায়, সেটিই চূড়ান্ত খেলা, ফাইনাল শোডাউন। তিনি এমন যুক্তিও দেখালেন, ‘পাকিস্তানের বলাৎকার’ ঠেকাতে অন্য কোনো পথ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খোলা নেই, ‘আমাদের ও চীনের এক বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নের এক বন্ধুর সঙ্গে বিবাদে ঠকে যাবে, তা তো হতে দিতে পারি না।’
পাকিস্তানের সমর্থনে কিসিঞ্জার আরও একটি ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিলেন। মার্কিন কংগ্রেস আগেই পাকিস্তানকে কোনো অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সে কথা অগ্রাহ্য করে কিসিঞ্জারের পরামর্শে নিক্সন জর্ডানের মাধ্যমে যুদ্ধবিমান ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ব্যাপারটা বেআইনি, খবরটা জানাজানি হলে তিনি বিপদে পড়বেন, সে কারণে নিক্সন কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। কিসিঞ্জার তাঁকে আশ্বাস দিলেন, ‘যদি এই তথ্য ফাঁস হয়, তো আমরা সাফ অস্বীকার করব।’
বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে দীর্ঘ সময় পাকিস্তানি সেনারা টিকে থাকতে পারবে না, এ কথা কিসিঞ্জার ও নিক্সনের অজ্ঞাত ছিল না। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁরা বঙ্গোপসাগরে ভারত-বাংলাদেশ নৌসীমানায় পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
কোনো ব্যবস্থাই কাজে লাগেনি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইয়াহিয়া-কিসিঞ্জার-নিক্সন ঠেকাতে পারেননি। কিসিঞ্জার পরে তাঁর হোয়াইট হাউস ইয়ার্স গ্রন্থে সাফাই গেয়েছেন, তাঁর জন্যই (পশ্চিম) পাকিস্তানকে বাঁচানো গেছে। বাংলাদেশের গণহত্যায় তিনি বাধা দেননি, কিন্তু ‘সবই করতে হয়েছিল পাকিস্তানকে বাঁচাতে’।
ইতিহাসের রায়
ইতিহাস কীভাবে এই শতবর্ষী কূটনীতিককে মনে রাখবে? বিশ শতকের রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব অস্বীকার করার জো নেই। আগ্রাসী মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির তিনিই প্রণেতা। ভিয়েতনাম থেকে বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে চিলি—বিগত শতকের প্রতিটি প্রধান দুর্ঘটনায় তাঁর হাতের দাগ লেগে রয়েছে। জাতীয় স্বার্থের নামে যে ‘রিয়েল পলিটিক’ তিনি প্রস্তাব করেন, তার কারণে শুধু লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানিই ঘটেনি, বিশ্বের মানুষের কাছে আমেরিকা নিন্দিত হয়েছে। বিশ ও একুশ শতকে আমেরিকার ইতিহাস যে তার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ইতিহাস, তার রূপকার কিসিঞ্জার।
বাংলাদেশের মানুষ এই কিসিঞ্জারকে মনে রাখবে খুনে ইয়াহিয়ার দোসর হিসেবে। সাংবাদিক ও লেখক সেইমোর হার্শ লিখেছেন, নিজের ক্ষমতা ব্যবহারে কিসিঞ্জার ছিলেন অন্ধ। হিচেন্স বলেছেন আরও শক্ত কথা, ‘কিসিঞ্জার হলেন ক্ষমতার পর্নোগ্রাফির এক প্রতীক।’
ইতিহাসবিদ গ্যারি ব্যাসের কথায়, ‘১৯৭১ সাল নিক্সন ও কিসিঞ্জারের “লজ্জার ইতিহাস”। সেখানে আসল লক্ষ্য ছিল নিক্সনের পুনর্নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং নিজের জন্য ইতিহাসে নাম কেনা।’
কিন্তু কিসিঞ্জারের শেষ রক্ষা হয়নি। বাংলাদেশের অভ্যুত্থান তিনি ঠেকাতে পারেননি। ঠেকাতে পারেননি পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা। চিলিতে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন বটে; কিন্তু সে দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এখন একজন বামপন্থী। তাঁর চালে নিক্সন পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির জন্য তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়।
মানতেই হবে, হিসাব-নিকাশের শেষ পাতায় কিসিঞ্জার একজন বীর নন, খলনায়ক হিসেবে পরিচিত হবেন।