রাজশাহীর পুঠিয়া প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে ধানি জমিতে অবাধে পুকুর খনন
রাজশাহীর পুঠিয়া
প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে ধানি জমিতে অবাধে পুকুর খনন
শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের তিনটি বিল ঘুরে ছোট-বড় ৩০টির বেশি পুকুর পাওয়া গেছে। কয়েকটি সম্প্রতি ও বাকিগুলো ৪-৫ বছরের পুরোনো।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ভালুকগাছি ও শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের অন্তত ১২টি বিলের পানি নামে চন্দ্রাবতী খাল দিয়ে। কয়েক বছর ধরে সেই খালের মুখে পুকুর খননের হিড়িক পড়েছে। সর্বশেষ হাড়োগাথী বিলে খালের মুখে চলছে ১৫ বিঘা আয়তনের পুকুর খনন। ইতিমধ্যে পুকুরের পাড় বাঁধার কাজ শেষ হয়েছে।
এভাবেই পুঠিয়া উপজেলাজুড়ে ধানি জমিতে অবাধে পুকুর খনন করা হচ্ছে। প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে এসব পুকুর কাটা হচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তাঁদের ভাষ্য, হাড়োগাথী পুঠিয়ার অন্যতম ধানি জমির বিল। ওই বিল দিয়ে বর্ষায় অন্যান্য বিলের পানি নিষ্কাশিত হয়ে খালে পড়ে। পুকুর কাটায় অন্তত ৩০০ বিঘা জমির ফসল জলমগ্ন হয়ে পড়বে।
প্রশাসনের লোকজন বলছেন, গভীর রাতে খননকাজ করে দুর্বৃত্তরা। অভিযানে গেলে টের পেয়ে যায়। তাঁরা যেখানেই খবর পাচ্ছেন, সেখানেই অভিযানে যাচ্ছেন। সম্প্রতি বেলপুকুরিয়ায় রাত আড়াইটায় অভিযান চালিয়েছেন। এরপরও ধানি জমিতে পুকুর খনন বন্ধ হচ্ছে না।
উপজেলা কৃষি ও মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, পুঠিয়ায় মোট কৃষিজমি ৯ হাজার ৬২৯ হেক্টর। আর ১ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে ৭ হাজার ৭৬২টি পুকুর। পুকুরগুলোর অধিকাংশই গত কয়েক বছরে খনন করা হয়েছে। এসব পুকুর খনন করতে কৃষি বিভাগ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়নি। যদিও কৃষিজমি সুরক্ষা আইন-২০১৬ (খসড়া)-এর ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, কোনোভাবেই কৃষিজমির ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। আর ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ আইনে কৃষিজমি, পাহাড় ও টিলার মাটি কেটে ইট তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে
সম্প্রতি শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের তিনটি বিল ঘুরে দেখা গেছে, রুইয়ের বিলে খালের পাশ দিয়ে অন্তত ২০টি পুকুর কাটা হয়েছে। পুকুরের ফাঁকে ফাঁকে কৃষিজমি। পুকুরগুলো ৫-৭ বছরের পুরোনো। কেউ আপসে বা কাউকে জিম্মি করে জমি ইজারা নিয়ে পুকুরগুলো কাটা হয়েছে। রুইয়ের বিলের দক্ষিণে কাইরের বিলে বড় বড় অন্তত ১০টি পুকুর দেখা যায়। একেকটির আয়তন ৩০-৪০ বিঘা। সম্প্রতি কাটা পুকুরগুলোর পাড়ের মাটি এখনো নতুন। দক্ষিণে হাড়োগাথী বিলে ১৫ বিঘা জমিতে পুকুর কাটা হচ্ছে। ঈদের আগে পুকুরটির খননকাজে এলাকাবাসীর বাধায় কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর গত মঙ্গলবার রাতে আবার খনন শুরু হয়। সেখানে পুকুর কাটা হলে তিন-চারটি বিলের পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যাবে।
হাড়োগাথী বিলে পুকুর খননের জন্য দুই বিঘা জমি দিয়েছেন স্থানীয় মজিবুর রহমান। তিনি বলেন, এলাকার পানি দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে খালে প্রবাহিত হয়। কয়েক বছর ধরে খালের উত্তর পাশের বিলে পুকুর খনন করায় পানি যাচ্ছে না। জলাবদ্ধতায় পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় ভালো ফসল হয় না। এ জন্য অন্যদের মতো বিপদে পড়ে তিনিও জমি দিয়েছেন। এক বিঘা জমিতে কিছু না করেই বছরে ৪২ হাজার টাকা পাবেন। পুকুরটি পাঁচ বছরের জন্য দিয়েছেন।
পুকুরের দক্ষিণ অংশের কৃষকেরা পুকুর খননের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। তাঁদের শঙ্কা, পুকুরটি কাটা হয়ে গেলে তাঁদের জমি পানিতে নিমজ্জিত থাকবে। কারণ, পাড় বন্ধ হয়ে গেলে খালে পানি নামবে না।
পুকুরের দক্ষিণে দুই বিঘা ধানি জমি আছে এন্তাজ প্রামাণিকের। পুকুর খননের শুরু থেকেই তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। তবু দুই রাত ধরে খননকাজ চলছে। এন্তাজ প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, পুকুরটির দক্ষিণে যে পাড় বাঁধা হচ্ছে, সেখানে তাঁর জমি পড়েছে। শুরু থেকেই বাধা দিয়ে আসছেন। কিন্তু শুনছে না। আজও এলাকার কয়েকজন এসেছিলেন। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, জমি দেবেন না। তিনি বলেন, এই পুকুর হয়ে গেলে এলাকার সর্বনাশ হয়ে যাবে। এটা এখন কেউ না বুঝলেও বর্ষাকালে অনেকের বাড়িতেও পানি উঠতে পারে।
কাইরের বিলে চন্দ্রাবতী খাল থেকে শ্যালো মেশিনে পানি দিচ্ছিলেন কৃষক ওবায়দুল হক। খালের পূর্ব পাশে তাঁর ভুট্টাখেত। তিনি বলেন, বছর দুয়েক আগেও বিলে কোনো পুকুর ছিল না। এখন পুকুর আর পুকুর। খালে পানি নামতে পারে না। এভাবে পুকুর খনন হতে থাকলে হয়তো খালই মরে যাবে। তিনি বলেন, পুকুর কাটতে তিনি জমি দেবেন না। কৃষকেরা লোভে পড়ে জমি ইজারা দিচ্ছেন। ১০-২০ বছর পর পুকুরের কাজ হবে না। তাঁর দাবি, পুকুর খননে প্রশাসনও জড়িত। না হলে পুকুর কাটার মহোৎসব চলত না।
হাড়োগাথী বিলের পুকুরটি স্থানীয় ভালুকগাছি ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মুকুল হোসেন খনন করছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তবে মুকুল হোসেন সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, পুকুর খননের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তাঁর জমিতে পানি জমে থাকে। এ জন্য অন্যদের সঙ্গে তিনিও জমি দিয়েছেন। এলাকার কেউ বললেই কি তিনি পুকুর খননকারী হয়ে যাবেন? নয়ন নামের একজন খনন করছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। তবে অভিযোগের বিষয়ে নয়নকে ফোন করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ কে এম নূর হোসেন নির্ঝর প্রথম আলোকে বলেন, তিনি পুঠিয়ায় দায়িত্বে এসেছেন ৯ মাস। প্রথম ৬ মাস পর্যন্ত পুকুর খনন বন্ধ রাখতে পেরেছেন। পরে আর পারছেন না। গভীর রাতে খনন শুরু করে। অভিযানে গেলে কীভাবে যেন টের পেয়ে যায়। যেখানে খবর পাচ্ছেন, সেখানেই যাচ্ছেন। গত বুধবারও বেলপুকুরিয়া ইউনিয়নে রাত আড়াইটার দিকে অভিযান চালিয়েছেন। হাড়োগাথী বিলের বিষয়ে বলেন, ঈদের আগে সেখানে অভিযান চালানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকালে একজন ফোন করে জানিয়েছেন, আবার খনন শুরু হয়েছে। তাঁরা আবার অভিযান চালাবেন