চট্টগ্রাম জলদস্যুদের নতুন দল দায়িত্ব নেওয়ার পর, যোগায়োগ করতে পারেননি জিম্মি বাংলাদেশিরা

চট্টগ্রাম  জলদস্যুদের নতুন দল দায়িত্ব নেওয়ার পর, যোগায়োগ করতে পারেননি জিম্মি  বাংলাদেশিরা

সারোয়ার সুমন,

জলদস্যুদের নতুন দল দায়িত্ব নেওয়ার পর আজ শনিবার দিনভর নাবিকদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার ২৩ নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করার পর প্রতিদিন নাবিকদের কেউ কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ করেছেন স্বজন কিংবা জাহাজ মালিকদের সঙ্গে। কিন্তু আজ দিনভর জিন্মি থাকা নাবিকদের কেউ জাহাজ মালিক কিংবা স্বজনদের সঙ্গে কোনোভাবে করতে পারেনি। এই প্রথম একটি দিন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিলেন নাবিকরা।  ধারণা করা হচ্ছে, মালিক পক্ষের উপর চাপ তৈরি করতেই এমন যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে জলদস্যুরা। তবে আজও জলদস্যুরা মুক্তিপণ হিসাবে কোনো নির্দিষ্ট অংকের টাকা দাবি করেনি ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’র নিয়ন্ত্রণ বৃহস্পতিবার থেকে নিয়েছে জলদস্যুদের নতুন আরেকটি দল। মঙ্গলবার জাহাজটি জলদস্যুর কবলে পড়ার পর বৃহস্পতিবার সোমালিয়ার উপকূল হতে সাত নটিক্যাল মাইল দূরে জাহাজটি নোঙর করেছিল। এরপর জলদস্যুদের আগের দল জাহাজ থেকে নেমে পড়ে। আরও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ১৫-২০ জনের নতুন আরেকটি দল জাহাজের দায়িত্ব বুঝে নেয়।  নোঙর তুলে শুক্রবার বিকেলে তারাই জাহাজটির অবস্থান পরিবর্তন করে। এদের সঙ্গে আছেন ইংরেজি জানা একজন দোভাষী। আজ শনিবার পর্যন্ত সোমালিয়ার জলদস্যুরা মুক্তিপণ দাবি করেনি। এ ব্যাপারে মালিকপেক্ষরও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেনি তারা। ধারণা করা হচ্ছে, শিগগির তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে মুক্তিপণের প্রস্তাব পাঠাবে জলদস্যুরা।  এদিকে জাহাজটির আবার অবস্থান পরিবর্তনের খবর শুনে আতঙ্ক বেড়েছে জিম্মিদের পরিবারে। উৎকণ্ঠা নিয়ে স্বজনরা ঘটনার কারণ জানতে চাচ্ছেন জাহাজের মালিকপক্ষের কাছে। আজ দিনভর নাবিকরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এই উদ্বেগ আরও বেড়েছে স্বজনদের। জাহাজের মালিকপক্ষের মুখপাত্র ও কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘বৃহস্পতিবার জলদস্যুদের নতুন আরেকটি দল জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এটি উপকূল থেকে চার নটিক্যাল মাইল দূরে গিয়ে নোঙর করায়। শুক্রবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে জাহাজটি অবস্থান পাল্টে এখানে নোঙর ফেলে। জলদস্যুদের কেউ আমাদের সঙ্গে এখনও মুক্তিপণের ব্যাপারে যোগাযোগ করেনি। তবে নাবিকেরা সবাই ভালো, সুস্থ আছেন।’ আজ দিনভর নাবিকরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় উদ্বেগ উৎকন্ঠা বেড়েছে স্বজনদের। এদেরই একজন নাবিক সাজ্জাদের স্ত্রী নাজমিন আকতার নুপুর। আজ নাবিকদের কেউ যোগাযোগ না করায় মালিকপক্ষের কাছে ফোন করেছেন তিনি। নাবিকদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর জানতে চান তিনি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে খালাতো বোন নাজমিন আকতার নুপুরের সঙ্গে বিয়ে হয় সাজ্জাদ হোসেনের। কাবিননামা হওয়ার পরদিনই জাহাজে উঠেন নাবিক সাজ্জাদ হোসেন। কথা ছিল ফিরে এসে জাঁকজমক আয়োজনে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে ‘এমভি আব্দুল্লাহ’ জাহাজের নাবিক সাজ্জাদ হোসেনের। ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে এখন জিম্মি হয়ে আছেন তিনি। কবে নাগাদ মুক্তি মিলবে, তা জানেন না সাজ্জাদের নব বিবাহিতা স্ত্রী নুপুরও।  নাবিকদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন জানান, এমন বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা জলদস্যুদের একটি কৌশল। চাপ বাড়াতে তারা এমনটি করে। এটা নিয়ে স্বজনদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। জলদস্যুরা মুক্তিপণের জন্য নিজ থেকেই যোগাযোগ করবে। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে ‘এমভি আবদুল্লাহ’ ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। সশস্ত্র জলদস্যুরা মাত্র ১৫ মিনিটে ২৩ নাবিককে জিম্মি করে জাহাজটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এর পর সোমালিয়া উপকূলের দিকে যাত্রা শুরু করে। বৃহস্পতিবার বিকেলে সোমালিয়ার গ্যারাকাড উপকূলে পৌঁছেছে কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজটি। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর একই গ্রুপের আরেকটি জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। সেই জাহাজের নাম ‘এমভি জাহান মণি’। বড় অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে ১০০ দিনের মাথায় ওই জাহাজ থেকে মুক্তি পান ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রী। শুধু এমভি আবদুল্লাহ নয়; আরও অনেক জাহাজের বাংলাদেশি নাবিক ও ক্রু সোমালিয়ান জলদস্যুদের কাছে অতীতে জিম্মি হয়েছিলেন। তাদের কেউ ২০ মাস পর, কেউ ১০ মাস পর জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পান। ২০১২ সালে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে ২০ মাসেরও বেশি সময় জিম্মি থাকার পর বাংলাদেশি সাতজন নাবিক মুক্তি পান। ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর ভারত মহাসাগর থেকে মালয়েশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ ‘এম ভি আলবেডো’কে জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এ সময় তারা জাহাজটিতে থাকা ২২ জন কর্মকর্তা এবং ক্রুকেও জিম্মি করে। এই ২২ জনের মধ্যে ছিলেন ৭ জন বাংলাদেশি, ৭ জন পাকিস্তানি, ৬ জন শ্রীলঙ্কান এবং একজন করে ভারতীয় ও ইরানি নাগরিক। তাদের সবাই মুক্তিপণ দিয়ে দীর্ঘ সময় পর মুক্ত হয়েছিলেন।  কেএসআরএম গ্রুপের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মনি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পায় ১০০ দিন পর। জিম্মি হওয়ার আট মাস পরও সোমালিয় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ঘটনার সাক্ষী আছেন দুই বাংলাদেশি নাবিক। তাদের একজন নাবিক জাফর ইকবাল। অন্যজন নাবিক গিয়াসউদ্দিন আজম খান। তারা জিম্মি হওয়া ‘এমভি মারিয়া মার্গারেট’ নামের জার্মান পতাকাবাহী জাহাজে কর্মরত ছিলেন।