জেলে না গিয়ে বঙ্গভবনে শপথ নিলাম: ড.মুহাম্মদ ইউনূস

জেলে না গিয়ে বঙ্গভবনে শপথ নিলাম: ড.মুহাম্মদ ইউনূস
জেলে না গিয়ে বঙ্গভবনে শপথ নিলাম: ড.মুহাম্মদ ইউনূস

আপনি কীভাবে এই বিরাট পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগটা কীভাবে হলো? আপনি কোন পর্যায়ে এসে সম্মতি দিলেন?

ড. ইউনূস: ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। পত্রিকায় টেলিভিশনের নিউজে তাঁদের দেখছিলাম। বরাবর যেভাবে আন্দোলন হয়, এভাবেই দেখছিলাম। আমি তখন বিদেশে ছিলাম যখন এই আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছিল। প্যারিস অলিম্পিকে একটা দায়িত্ব পালন করছিলাম। ওটার ডিজাইনিংয়ে আমি ইনভলভড ছিলাম। এ সময়ে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। সেই সময় প্যারিসের একটা রাস্তার নাম আমার নামে নামকরণ করা হয়েছিল, সেটার উদ্বোধন করেছিলাম। কাজেই আমি এদিকে দেখছি, ওই দিকেও দেখছি, দূরের দৃশ্য হিসেবে।

আমার অফিস থেকে আমার সঙ্গে যারা যোগাযোগ রাখে তারা বলছিল: ‘স্যার এখন ফিরবেন না, এখন অবস্থা ভালো না। এলেই বোধ হয় আপনাকে জেলে নিয়ে যাবে। আপনি একটু দূরে থাকেন। পরিস্থিতি বুঝে আপনাকে বলব, কখন আসতে হবে।’ কাজেই আমি পরিকল্পনা করছিলাম বার্লিনে যাব, বার্লিনের পর রোমে যাব। তারপর ব্রাজিল যাব ইত্যাদি। দেশে ফিরে আসব এবং এ রকম একটা দায়িত্ব নিতে হবে, এটা একদম মাথায় ছিল না। এ সময় ছাত্রদের একজন আমার অফিসকে জানাল যে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। ছাত্রদের কথা এই প্রথম শুনলাম। জানতে চাইলাম, কী আলাপ করতে চায়। তখন আমাকে জানানো হলো, আপনাকে সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে। আমি বললাম, এটা তো ভিন্ন কথা। তাকে বললাম, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে? সে জানাল, আলাপ হয়েছে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমিও আলাপ করি, কী বলে দেখি। সে যোগাযোগ করিয়ে দিল, আমি আলাপ করলাম। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ো না। বরাবরই আমি এই দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থেকেছি। এই দায়িত্ব নেওয়া ঠিক হবে না। তোমরা অন্য একজনকে ভালো করে খুঁজে দেখো। তারা বলল, না স্যার আর কেউ নেই। আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তাদের আবার বললাম, তোমরা খোঁজ করো। খোঁজ করার পর আমাকে বলো, কী দাঁড়াল। তখন সে আমাকে জানাল, ঠিক আছে স্যার, কাল আপনাকে জানাব। পরদিন আবার সে ফোন করল। সে জানাল, স্যার, উপায় নেই। আপনাকেই আসতে হবে। আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। অবিলম্বে আসতে হবে।

অতীতে আমরা সংস্কারের দিকে যাইনি। শুধু এক সরকার থেকে আরেক সরকারে চলে গিয়েছি। এবার সংস্কারের একটা বিষয় এসেছে এবং সেটাকে আমরা সামনে রেখেছি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান উপদেষ্টা

আমি তখন জানালাম, আমি তো এখন হাসপাতালে। আমি তো অত তাড়াতাড়ি আসতে পারছি না। আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে দেখি, কী বলেন উনি। তবে তোমরা যখন এত প্রাণ দিয়েছ এবং বলছ যে আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে, যতই আমার আপত্তি থাকুক, আমি এ ব্যাপারে সম্মতি দিলাম। তবে আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে বলতে পারব, আমি কখন আসতে পারব। সে বলল, না স্যার, আপনাকে তাড়াতাড়ি আসতে হবে। আমি হাসপাতালে ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করলাম। ডাক্তার বললেন, আপনার তো আগামী দিনও হাসপাতালে থাকার কথা। আমরা চেষ্টা করি আপনাকে আগামীকাল ছেড়ে দিতে পারি কি না। পরদিন সকালে ওঠার পর ডাক্তার বললেন যে আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। ডাক্তার ছেড়ে দিলেন। আমি দেশে চলে এলাম।

প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে
প্রথম সময় সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়েছবি: জাহিদুল করিমএই সিদ্ধান্ত তো আপনি নিলেন। ছাত্রনেতারা ছাড়া বাইরের আর কারও সঙ্গে কি আপনার পরামর্শ করার সুযোগ হয়েছিল?

ড. ইউনূস: আর কে যে আছে, তা–ও তো আমি জানি না। আমার কিছু জানা ছিল না।

প্রতিবেদক

ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক...

ড. ইউনূস: এদের কারও সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না। তারা কারা, ঢাকায় এসে তাদের চেহারা আমি দেখেছি। তাদের সঙ্গে কথা হলো। এয়ারপোর্টে তারা ছিল। তখন তাদের সঙ্গে পরিচয় হলো।

প্রতিবেদক

আপনি দেশের একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, দুই মাস আগে। সময়টা ছিল যথেষ্ট ঘটনাবহুল। সময়টা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ড. ইউনূস: একেবারে দ্রুতগতিতে সবকিছু ঘটেছে। আমি ফিরে এলাম। সেদিন রাতেই শপথ গ্রহণ করলাম। সব ওলট–পালট। দেশে ফিরে এসে কোথায় জেলে যাব, এখন অন্য দিকে চলে গেলাম! কী করতে হবে? এরা কারা? শপথ গ্রহণে কারা কারা থাকবে? সবকিছুই নতুন! সবকিছু ভিন্ন পরিস্থিতি। তবু মনে করলাম দায়িত্ব যখন তারা নিতে বলেছে, আমি রাজি হয়েছি, কাজেই আমি সে দায়িত্ব পালন করব। এভাবেই একটা অপরিচিত জগতের মধ্যে অপরিচিত সঙ্গী নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলো।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসছবি: জাহিদুল করিম
প্রথম সময়

আপনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। এরপর আপনার কখনো বঙ্গভবনে, গণভবনে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। নাকি গিয়েছেন?

ড. ইউনূস: আমি গিয়েছি যদ্দিন আওয়ামী লীগের বাইরের সরকার ছিল, তারা আমাকে আমন্ত্রণ করেছে। আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও আমি দাওয়াত পেয়েছিলাম এবং সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম।

প্রথম সময়

এবার আপনি আবার জাতিসংঘ অধিবেশনেও যোগ দিয়ে এলেন। সব প্রথা ভেঙে জো বাইডেনের সঙ্গে আপনার বৈঠক হলো। তারপর বিল ক্লিনটন। এর বাইরেও আরও অনেক রাষ্ট্রনেতা। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। আমরা দেখলাম, অনেক উৎসাহ–উদ্দীপনা বাংলাদেশের পরিবর্তনে এবং সেটা আপনাকে কেন্দ্র করে। আপনার উপস্থিতি, আপনার পরিচিতি অনেক কাজে লেগেছে। অনেক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন। সব মিলিয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া পেলেন নতুন বাংলাদেশ নিয়ে?

ড. ইউনূস: একটা হলো, তাদের সবার মনে উৎসাহ জেগেছে। উৎসাহ জেগেছে যে এই দেশটা আবার নতুন করে দাঁড়াতে পারবে। দেশের যে গতিপ্রকৃতি তারা দেখছিল, তাতে তারা উৎসাহ বোধ করছিল না। এই পরিবর্তনের ফলে এবং আমাকে সামনে পেয়ে এদের অনেকেই খুব উৎসাহ বোধ করেছে। এদের অনেকেই ছিল আমার পরিচিত মুখ ও বন্ধু, যাদের সঙ্গে আমার আগে থেকে ঘনিষ্ঠতা ছিল। কাজেই আমাকে কাছে পেয়ে তারা খুব উৎসাহ বোধ করেছে। এবং সেই উৎসাহ তারা নানাভাবে প্রকাশ করেছে।

আমরা আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছি। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বৈঠক বন্ধুদের বৈঠকে পরিণত হয়েছে। আলাপ হয়েছে, কী দরকার তোমরা বলো, সেভাবে আমরা ব্যবস্থা নেব। সত্যি সত্যি তারা তাদের লোকজন নিয়ে এসেছে। অফিসারদের অনেকে আমাকে চেনে, যেহেতু নানা কাজে নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সেভাবেই তারা গ্রহণ করেছে এবং খুব উৎসাহসহকারে করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের সাহায্য–সহযোগিতা কী দরকার আমাদের। আমিও একেবারে পরিষ্কারভাবে বলেছি যে অতীতের মতো করে দেখলে হবে না। নতুন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং নতুন ভঙ্গিতে চিন্তা করতে হবে। আগের ক্যালকুলেশন বাদ দিতে হবে। অনেক বড় স্তরের ক্যালকুলেশন দিতে হবে। আমরা বড় জাম্পে যেতে চাই। এবং আগে অনেক শর্ত দিয়ে যেভাবে রাখছিল, সেভাবে না। যার সঙ্গেই আলাপ হচ্ছিল, এই একটা বিষয়ে জোর দিচ্ছিলাম। তারাও অ্যাপ্রিশিয়েট করছিল। সঙ্গে সঙ্গে একজন তো ওখান থেকে ফোন করে নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছিল, ওইটা করে দাও।

আমরা কথা বলছি আর ফাঁকে ফাঁকে নির্দেশও চলে যাচ্ছে। তো খুব উৎসাহ বোধ করলাম। আমি বললাম, শুধু টাকার অঙ্ক বাড়ালে হবে না, এটার যে গতি...আমরা এখানে চুক্তি সই করলাম, ওই টাকা আসতে আসতে বহু বছর লেগে যায়, শেষ পর্যন্ত ওটা কাজে লাগে না। আমি বলেছি, আমাদের দ্রুতগতিতে দরকার। এই পরিবর্তনে আশু পরিবর্তন দরকার। কাজেই সব রকমের আয়োজনের যে ব্যবস্থা তোমাদের আছে, তা সংক্ষিপ্ত করে আমরা যাতে কাজে লেগে যেতে পারি, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে করো। সবাই অ্যাপ্রিশিয়েট করে বলল: আমরা বিষয়টা বুঝেছি। দ্রুতগতিতে যাতে হয়, আমরা সেটার ব্যবস্থা করব।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার নেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার নেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানছবি: জাহিদুল করিম: 

তারা দ্রুতগতিতে করল। আপনাকেও তো সবাইকে নিয়ে দেশে কিছু করার বিষয়টি দেখতে হবে। সে জন্য সংস্কারের যে উদ্যোগগুলো আপনি নিয়েছেন, সেগুলো জরুরি।

ড. ইউনূস: অবশ্যই। আমাদের জোর ছিল সংস্কারে। আমাদের যদি সংস্কার করতে হয়, দ্রুতগতিতে করতে হবে। ধীরে–সুস্থে সংস্কার করার সুযোগ আমাদের নেই। কাজেই সেই সংস্কারগুলো আমাদের এখন থেকে শুরু করতে হবে। একটা বিধ্বস্ত কাঠামোর ওপর আমরা শুরু করেছি।: 

আমি এখানটায় আসছিলাম। আপনি তো বাইরে থেকে সরকারের ভেতরটা অতটা জানতেন না। সাধারণভাবে জানতেন অন্যায়, অবিচার, রাজনীতিকরণ, দুর্নীতি ইত্যাদি। তো আপনি এসে কী দেখলেন? কী পেলেন?

ড. ইউনূস: ভাঙা হাট। কোনো জিনিস ফাংশন করে না। একটা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্ট্রাকচার আছে, এক ব্যক্তিপূজার জন্য যা যা লাগে, সে ব্যবস্থাগুলো আছে। ওনার হুকুমে কী কী হয়, ওনার ইচ্ছাপূরণের জন্য সব ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের ইচ্ছাপূরণের জন্য তাদের কোনো ব্যস্ততা নেই। কাজেই এ রকম একটা ভাঙাচোরা জনপ্রশাসন নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হয়েছে