দেশজুড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত, নিহত ১০১
অসহযোগ কর্মসূচিতে নিহত ১০১
রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, গুলি, হামলা ও পাল্টা হামলায় গতকাল রোববার অগ্নিগর্ভ ছিল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। এতে নিহত হয়েছেন ১৪ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১০১ জন। নিহতদের মধ্যে রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন এলাকার ৯১ জন। আর ঢাকায় প্রাণ গেছে ১০ জনের। গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন তিন সহস্রাধিক। নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, এক সাংবাদিক ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদের ১৯ নেতাকর্মী রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সিরাজগঞ্জে। সেখানকার এনায়েতপুর থানায় হামলা চালিয়ে ১৩ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সংঘাতে গতকাল সিরাজগঞ্জে প্রাণ গেছে ২২ জনের। আন্দোলন ঘিরে গত কয়েক দিনে এ নিয়ে মোট নিহত হয়েছেন ৩১৬ জন।
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গতকাল দিনভর আওয়ামী লীগ সমর্থক ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। বেশ কয়েক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি এবং দলীয় কার্যালয়ে হামলা হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতাল, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা, থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ২৭টি থানা-ফাঁড়ি, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, রেঞ্জ অফিসে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। সংঘর্ষে জড়িত অনেকের হাতে লাঠিসোটা ও আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীনদের অন্তত ৩৫ কার্যালয়ে ভাঙচুর শেষে পুড়িয়ে দিয়েছে। বিপরীতে বিএনপির দুটি কার্যালয়ে আগুন দেয় সরকার সমর্থকরা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আজ সোমবার থেকে তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, আজ কারফিউ ভাঙলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সোমবার থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ এবং সারাদেশের নিম্ন আদালত বন্ধ ঘোষণা করেছে কোর্ট প্রশাসন। দেশের সব তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে বিজিএমইএ।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে আজ সোমবার করার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীসহ সব অভিভাবককে ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেছে সরকার।
রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, শাহবাগ, বাংলামটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ছিল উত্তাল। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারদলীয় নেতাকর্মীর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) হামলার পর ১৩টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। সেখানে আন্দোলনকারীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার কোনো কোনো এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও আন্দোলনকারীর মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সংঘাত হয়। রাজধানীর রামপুরাসহ কয়েকটি এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ, বাংলামটর, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেটে জড়ো হয়। এসব এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে।
দিনভর সংঘাতে ঢাকায় নিহতদের মধ্যে চার শিক্ষার্থী ও এক আওয়ামী লীগ নেতাও আছেন। নিহত আওয়ামী লীগ নেতা প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আড়াই শতাধিক। তাদের অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ। বিক্ষোভকারীর একটি অংশ শাহবাগ থেকে দুপুরের দিকে বাংলামটরের দিকে যাত্রা করে। এ সময় রামপুরা থেকে মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা বাংলামটরে যুক্ত হয়। পরে একযোগে তারা কারওয়ান বাজার হয়ে বিকেল ৩টায় ফার্মগেটে পৌঁছায়। এরপর সেখানে আরেক দফা সংঘর্ষ হয়। এতে ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারে অন্তত দু’জন নিহত এবং পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন।
ঢাকার বাইরে নিহতদের মধ্যে সিরাজগঞ্জে ১৩ পুলিশসহ ২২, লক্ষ্মীপুরে ১১, ফেনীতে ৮, নরসিংদীতে ৬ আওয়ামী লীগ নেতা, সিলেটে ৬, কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের তিনজনসহ ৫, রংপুরে ৫, মাগুরায় ৪, বগুড়ায় ৩, মুন্সীগঞ্জে ৩, পাবনায় ৩, কুমিল্লায় পুলিশসহ ৩, শেরপুরে ৩, জয়পুরহাটে ২, বরিশালে এক আওয়ামী লীগ নেতা, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা, টাঙ্গাইলে ও হবিগঞ্জে একজন করে রয়েছেন। ঢাকার পাশের কেরানীগঞ্জে এক আওয়ামী লীগ নেতা, সাভারের আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে একজন করে নিহত হয়েছেন।
উত্তরায় বিক্ষোভে গুলি
রাজধানীর উত্তরায় আন্দোলনকারীর বিক্ষোভে গুলি চালিয়েছে অস্ত্রধারীরা। অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও অন্যান্য পেশার লোকজন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে উত্তরার রাজলক্ষ্মীর কুশল সেন্টারের সামনে আহত হন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম (৬৭)। তাঁকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আনোয়ারুল সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসানের চাচাতো ভাই।
কেমন ছিল যাত্রাবাড়ী
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গতকাল দুপুর ১টার দিকে অবস্থান করা দুই শতাধিক আওয়ামী লীগ অনুসারীকে মুহূর্তেই ধাওয়া দিয়ে অলিগলিতে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের বসে থাকা চেয়ারগুলো গুঁড়িয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। পরে পুরো চৌরাস্তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে তারা। অথচ এর আগে সকাল থেকেই চেয়ার পেতে বসে থাকা আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও অনুসারীরা লাঠি নিয়ে মাঝেমধ্যেই মিছিল করছিল।
সকাল থেকেই হানিফ ফ্লাইওভারের পূর্বপ্রান্ত থেকে সাইনবোর্ড এলাকা ছিল সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে। সড়কে যান চলাচল ছিল বন্ধ। সকাল ১০টার দিকে বিক্ষোভকারীরা যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার কাছাকাছি পৌঁছালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের সরিয়ে দেয়। সরকারবিরোধীরা ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজার কাছে থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে ছড়িয়ে পড়েন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাজলা ফুট ওভারব্রিজের পাশে একটি গলি থেকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে সরকার সমর্থকরা গুলি ছুড়লে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হয় ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া। আধা ঘণ্টা ধরে চলে এ অবস্থা। বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় আগুন দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। দুপুর ১টার দিকে টোলঘর প্রান্ত থেকে শত শত বিক্ষোভকারী যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা অভিমুখে এগোতে থাকে। এ সময় সরকারি দলের অনুসারীরাও লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে। পরে রাস্তার মাঝে ফ্লাইওভারের নিচে থাকা পুলিশ সদস্যরা সরে গিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে অবস্থান নেন। বিক্ষোভকারীরা থানার সামনে পৌঁছালে পুলিশের পক্ষ থেকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানানো হয়। এর পর সরকারি দলের অনুসারীদের ধাওয়া দিলে তারা আশপাশের অলিগলিতে ঢুকে যায়। সরকারি দলের অনুসারীরা কয়েকবার অলিগলি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেও বিকেল পর্যন্ত আন্দোলনকারীরাই চৌরাস্তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে।
রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডার পরিস্থিতি
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আফতাবনগরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করেন। এর এক ঘণ্টার মধ্যে খণ্ড খণ্ড মিছিলে আরও আন্দোলনাকারী যুক্ত হন সেখানে। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত আফতাবনগরের জহুরুল ইসলাম সিটির গেটে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে বিক্ষোভ করেন। এর পর তারা প্রগতি সরণিতে এসে সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেন। মেরুল বাড্ডা থেকে রামপুরা উলন পর্যন্ত রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। সকাল থেকেই ওই সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। সকাল থেকেই ওই এলাকায় পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়নি। অবশ্য বিটিভি ভবনের গেটে সেনাবাহিনী ও পুলিশ মোতায়েন ছিল। এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। দুপুর আড়াইটার পর আন্দোলনকারীদের একাংশ মিছিল নিয়ে শাহবাগের দিকে রওনা হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, উত্তাল ঢাকার মাঝে এক টুকরো রংতুলির ক্যানভাস যেন রামপুরা বনশ্রীর সি ব্লক। পিচঢালা কালো রাস্তা বিভিন্ন প্রতিবাদী লিখনচিত্রে পরিপূর্ণ। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা গতকাল এই লিখনচিত্র ও গ্রাফিতি করায় অংশ নিয়েছেন। শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ আশপাশের মানুষ স্লোগান দিতে থাকেন। কয়েকজন অভিভাবককে শিক্ষার্থীদের মাঝে খাবার বিতরণ করতে দেখা যায়।
মোহাম্মদপুর-বছিলায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বছিলা পর্যন্ত দিনভর পুলিশ, আন্দোলনকারী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই আন্দোলনকারীরা বছিলা ব্রিজ বেড়িবাঁধে তিন রাস্তার মোড় ও মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণে নেন। এ সময় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে আল্লাহ করিম জামে মসজিদের সামনে পুলিশের সঙ্গে যুবলীগ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। বিকেল পৌনে ৪টায় আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। চালানো হয় ছররা গুলি। এ সময় পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা একযোগে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করে। দুই ঘণ্টা সংঘর্ষ চলার পর আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়ে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড দখলে নেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তবে রাত ৮টায় বেড়িবাঁধের তিন রাস্তার মোড় থেকে বছিলা ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক আন্দোলনকারীদের দখলে ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ১২টার পর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা তিন রাস্তার মোড় এলাকা থেকে রাস্তায় নামতে শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। দুপুরে ১টার দিকে তারা রাস্তায় ব্যারিকেড দেন। বিকেল পৌনে ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মুখোমুখি অবস্থান নিতে শুরু করেন।
ঢাকায় প্রাণ গেল ১০ জনের
অসহযোগ আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ১০ জন নিহত হয়েছেন। উত্তরায় নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুল ইসলাম, জিগাতলায় গুলিতে মারা গেছেন হাবিবুল্লাহ বাহার ডিগ্রি কলেজের ছাত্র আবদুল্লাহ সিদ্দিকী, কারওয়ান বাজারে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রমিজ উদ্দিন রূপ, মিরপুরে মারা গেছেন বিএএফ শাহীন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী শাফিক উদ্দিন আহম্মেদ আহনাফ, ফার্মগেটে এলাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী তৌহদিুল ইসলাম, গুলিস্তানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কুমিল্লার জহির উদ্দিন, যাত্রাবাড়ীর কাজলার জুয়েল, শিক্ষার্থী রেজাউল করিম (১৬) ও সেলিম (৪০)। এ ছাড়া নিহত একজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। রাত ৮টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ২২২ জন আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। তাদের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ। ৬৩ জন ভর্তি হয়েছেন, বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছেন।
অনির্দিষ্টকাল কারফিউ
সহিংসতার ঘটনায় রোববার সন্ধ্যা থেকে পরর্বতী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত ঢাকাসহ সব বিভাগীয় সদর, সিটি করপোরশেন, পৌরসভা, শিল্পাঞ্চল, জেলা ও উপজেলা সদরের জন্য কার্যকর হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ র্কমর্কতা মো. শরীফ মাহমুদ এ তথ্য জানিয়েছেন। আন্দোলন ঘিরে গত ১৯ জুলাই থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করে সরকার।
গতকাল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারের জারি করা কারফিউতে সেনাবাহিনী সংবিধান ও আইনের আলোকে দায়িত্ব পালন করবে। জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রের গুরুত্বর্পূণ স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিন দিনের সাধারণ ছুটি
চলমান পরিস্থিতিতে আজ সোমবার থেকে টানা তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা করেছে সরকার। গতকাল বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নির্বাহী আদেশে এ ছুটি দেওয়া হয়েছে। ছুটিকালীন সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসতি, আধাস্বায়ত্তশাসতি এবং বেসরকারি অফিসগুলো বন্ধ থাকবে। তবে জরুরি বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, জ্বালনি, ফায়ার সার্ভিস ও বন্দরগুলোর র্কাযক্রম, পরচ্ছিন্নতা, টেলিফোন, ইন্টারনটে, ডাকসবো এবং এ-সংশ্লষ্টি কাজে নিয়োজিত যানবাহন ও কর্মীরা এ ছুটির আওতার বাইরে থাকবেন। এ ছাড়া হাসপাতাল ও জরুরি সেবা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট র্কমী, চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ডাক্তার ও কর্মী, ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জামাদি বহনকারী যানবাহন ও কর্মীরা এ ছুটির আওতার বাইরে থাকবেন।
সিরাজগঞ্জে পুলিশসহ নিহত ২২
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানা ঘেরাও করে কমপক্ষে ১৩ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে রায়গঞ্জ ও সদর উপজেলায় উপজেলায় আন্দোলনকারীর সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হয়েছেন। রায়গঞ্জে নিহতরা হলেন– দৈনিক খবরপত্রের রায়গঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিক, ব্রহ্মগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার লিটন ও তাঁর আপন ছোট ভাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম হোসেন টিটো, রায়গঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মেহেদী হাসান ইলিয়াস ও সাধারণ সম্পাদক আলামিন সরকার। সিরাজগঞ্জ সদরে নিহত তিনজন হলেন– শহরের মাছিমপুর দক্ষিণপাড়ার যুবদল নেতা রঞ্জুর শেখ, কর্মী গয়লা মহল্লার সুমন শেখ ও আব্দুল লতিফ।
লক্ষ্মীপুরে নিহত ১১
লক্ষ্মীপুরে আন্দোলনকারীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে পৌর শহরের পিংকি প্লাজার সামনের সড়কে সংঘর্ষে এবং প্রয়াত মেয়র আবু তাহের মিয়ার বাসার সামনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দু’জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন– সদরের বাঙ্গাখাঁ ইউপি সদস্য মো. শাহজাহান (৫০) ও ডুমছড়ি ইউপি সদস্য মো. হারুন (৪৫)। এ ছাড়া শাঁখারীপাড়ায় তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গুলিতে মারা গেছেন চার আন্দোলনকারী। তাদের তিনজন হলেন– আফনান পাটওয়ারী, কাউছার, সাব্বির ও মিরাজ। সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. অরূপ পাল এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে আন্দোলনকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়েছে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবু তাহের মিয়ার বাসভবন ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম সালাউদ্দিন টিপুর বাড়ি।
রণক্ষেত্র ফেনী, নিহত ৮
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ফেনী। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কের ফেনীর মহিপাল ছয় লেন ফ্লইওভার এলাকায় সংঘর্ষে অন্তত আটজন নিহত, সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ৭৫ জন আহত হয়েছেন।
নরসিংদীতে আ’লীগের ৬ নেতাকর্মী নিহত
নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদী পৌর এলাকায় দুপুর ১টার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর সংঘর্ষ হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ সমর্থক অন্তত ছয়জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীর জানান, আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের গুলি উপেক্ষা করে চড়াও হলে তারা দৌড়ে মাধবদী বড় মসজিদে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে ধরে এনে পিটিয়ে তাদের হত্যা করে আন্দোলনকারীরা। মাধবদী থানার ওসি কামরুজ্জামান ছয়জন নিহতের তথ্য জানিয়েছেন।
উত্তাল সিলেট, গোলাপগঞ্জে গুলিতে নিহত ৬
আন্দোলন ঘিরে সিলেট নগরী, গোলাপগঞ্জ উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর মধ্যে গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণ এলাকায় আন্দোলনকালে হামলা করা হয় পুলিশ ও বিজিবির গাড়িতে। ওই সময় সংঘাতে গুলিতে মারা গেছেন ছয়জন। আহত হয়েছেন ওসিসহ কমপক্ষে অর্ধশত। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ঘটনার পর লাশ নিয়ে উপজেলা সদরে বিক্ষোভ করে। ওই সময় আবার তাদের সঙ্গে দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
নিহতরা হলেন– পৌরশহরের ধারাবহর গ্রামের ব্যবসায়ী তাজউদ্দিন (৪৩), উপজেলার শিলঘাটের বাসিন্দা সানি আহমদ (১৮), নিশ্চিন্তপুর গ্রামের নাজমুল ইসলাম (২২), ঘুষখাঁও গ্রামের অটোরিকশাচালক গৌছ উদ্দিন, দপ্তরাই গ্রামের মিনহাজ আহমেদ ও রায়গড় গ্রামের দর্জি হাসান আহমেদ।
বিকেলে সিলেট-৩ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিবের অফিস, জেলা নির্বাচন অফিস ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদে হামলা করে আন্দোলনকারীরা। নগরীতে কমপক্ষে আহত হন ২০-৩০ জন।
কিশোরগঞ্জে আ’লীগের তিনজনসহ নিহত ৫
কিশোরগঞ্জে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের তিনজনসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দু’জন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর খরমপট্টি এলাকার বাসায় অগ্নিসংযোগে ও একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া সংঘর্ষের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন সদরের যশোদল এলাকার মো. জুলকার (৫০)। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসার দারোয়ান বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আতিকুল হক বুলবুল।
রংপুরে কাউন্সিলরসহ নিহত ৫
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে রংপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের দায়িত্বে নিয়োজিত সর্দার আবদুল জলিল তাদের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছেন।
রংপুর জেলা, মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলায় ক্ষমতাসীনদের কার্যালয় ও বাড়িতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রংপুর-২ (বদরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের এমপি আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক ও পৌর মেয়র টুটুল চৌধুরীর বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। মিঠাপুকুর উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিসসহ সাবেক এমপি এইচএন আশিকুর রহমানের বাসভবন, ইউএনও অফিস, আওয়ামী লীগ নেতা ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল কবির টুটুলের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়।
মাগুরায় ছাত্রদল নেতাসহ নিহত ৪
মাগুরা সদর ও মহম্মদপুর উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতাসহ চারজন নিহত ও অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। সদরে নিহতরা হলেন– জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক মেহেদী হাসান রাব্বী এবং পথচারী ফরহাদ হোসেন। মহম্মদপুরে নিহতরা হলেন– আমিনুর রহমান কলেজের একাদশ বর্ষের ছাত্র আহাদ আলী এবং বালিদিয়া গ্রামের কানু শেখের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী সুমন শেখ। আহাদ উপজেলা সদরের ব্যাপারীপাড়ার ইউনুচ আলীর ছেলে। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন রবিন শিকদার নামে আরেক শিক্ষার্থী। এদিকে মহম্মদপুরে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ছাড়াও ইউএনও অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধরা।
বগুড়ায় তিনজনকে গুলি ও পিটিয়ে হত্যা
বগুড়ায় কর্মসূচিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে দু’জন নিহত এবং একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ৭৭ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন পুলিশসহ তিন শতাধিক। থানা ঘেরাও, স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় একাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে এ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ায় শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
দুপচাঁচিয়া থানা ঘেরাওয়ের সময় পুলিশের গুলিতে মনিরুল ইসলাম (২৩) নামে এক ছাত্র নিহত হন। বগুড়া শহরের তিনমাথা এলাকায় পুলিশের গুলিতে জিল্লুর রহমান (৪৫) মারা যান। শহরের জেলা পরিষদের সামনে পিটিয়ে সেলিম রেজা (৪০) নামে এক পথচারীকে হত্যা করা হয়। এদিকে শিববাটি এলাকায় বগুড়া সদর-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপুর বাড়িতে ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ৩
মুন্সীগঞ্জ শহরের থানারপুল, হাসপাতাল রোড ও কৃষি ব্যাংকসংলগ্ন এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মী, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। তাদের তিনজন শ্রমিক ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল সূত্র দু’জন ও সিরাজদীখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স একজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে।
নিহতরা হলেন– শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকার রিয়াজুল ফরাজী (৩৫), মেহেদী হাসান (২৩) ও শহরের হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার মো. সজল (৩০)।
অন্যদিকে দিনভর সংঘর্ষে উভয়পক্ষের গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন শতাধিক। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। বিএনপির কর্মীরা পুড়িয়ে দিয়েছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ৫টি মোটরসাইকেল।
পাবনায় সংঘর্ষে নিহত ৩, গুলিবিদ্ধ অর্ধশত
পাবনায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ চত্বর মিছিল নিয়ে শহরে প্রবেশ করলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর চড়াও হয়। এ সময় ক্ষমতাসীনরা গুলি চালালে ঘটনাস্থলে দুই ও হাসপাতালে নেওয়ার পরে একজনের মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে অর্ধশত।
নিহতরা হলেন– পৌর এলাকার বলরামপুরের জাহিদুল ইসলাম (১৭) ও শহরের আরিফুর বেতেপাড়ার মাহিবুল ইসলাম (১৬), অন্যজনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। জাহিদুল পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের এবং মাহিবুল পাবনার ছিদ্দিক মেমোরিয়াল হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে।
আন্দোলনকারীরা লাশ নিয়ে শহরে মিছিল বের করার চেষ্টা করলে তাদের ধাওয়া দেয় পুলিশ ও সরকারদলীয়রা। এ সময় পুরো শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে।
কুমিল্লায় থানায় আগুন, পুলিশসহ নিহত ৩
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে থানায় দেড় সহস্রাধিক লোক হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, অস্ত্র-গুলি লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় এরশাদ আলী নামে এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। অপর ঘটনায় দেবিদ্বার পৌর এলাকায় ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আবদুর রাজ্জাক রুবেল নামে এক বাসচালককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। রুবেল স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী বলে বিএনপি দাবি করেছে। এ ছাড়া বিকেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংষর্ষে অজ্ঞাতপরিচয় একজন (২৭) নিহত ও অন্তত ২৫ জন আহত হয়। আহত হয়েছেন পাঁচ সাংবাদিক।
শেরপুরে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত তিন
শেরপুর শহরে আন্দোলনকারী, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক। তাৎক্ষণিকভাবে নিহত দু’জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন তুষার (২০) ও মাহাবুব (২১)। অন্যজন অজ্ঞাতপরিচয়।
সংঘর্ষের পর কয়েকশ যুবক পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনের বাসভবন এবং শেরপুর সদর থানায় হামলা করে। এ ছাড়া শহরের কলেজ মোড়ের তিনআনি বাজার এলাকায় পুলিশ সুপারশপ গুঁড়িয়ে দেয়।
বরিশালে আ’লীগ নেতা নিহত
বরিশালে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ নেতা টুটুল চৌধুরী (৬০) নিহত হয়েছেন। তাঁকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আন্দোলনকীরা নগরের নবগ্রাম সড়কে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এমপি ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা সদর রোডের বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর করে আগুন দিয়েছে।
বেলা ২টার দিকে আমতলার মোড়ে আন্দোলনকারীরা ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি টুটুল চৌধুরীকে বেদম পেটান। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
গাজীপুর নিহত নির্মাণ শ্রমিক
গাজীপুরের শ্রীপুরে গতকাল সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে তোফাজ্জল হোসেন (২২) নামে এক নির্মাণ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। তিনি বাড়ি পার্শ্ববর্তী নগর হাওলা গ্রামের বাসিন্দা।
এদিকে কালিয়াকৈর উপজেলায় আন্দোলনকারীরা বিকেলের দিকে সফিপুর আনসার প্রশিক্ষণ একাডেমির সামনে অবস্থান নিলে রাবার বুলেট ছোড়েন আনসার সদস্যরা। এতে শিশুসহ দুই শতাধিক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এর আগে দুপুরে কালিয়াকৈর থানার সামনে বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে আহত হন আরও অন্তত ৫০ জন। পরে আন্দোলনকারীরা চন্দ্রায় আওয়ামী লীগের দলীয় অফিসে এবং হাইওয়ে পুলিশের একটি বক্সে আগুন দেয়।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়া মাওনা চৌরাস্তায় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাছির মোড়লের পাঁচতলা বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল আলম রবিনের মাওনা চৌরাস্তার বাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়। কাপাসিয়ায় আন্দোলনকারী-সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষে ১৩ জন আহত হয়েছেন। আগুন দেওয়া হয়েছে কাপাসিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও ডাকবাংলোতে।
ভোলায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১
ভোলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে মো. জসিম (৪৫) নামে এক ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। পাঁচজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এদিকে দিনব্যাপী সংঘর্ষ চলাকালে জেলা আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ অফিস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া ডিসি অফিস, পৌর ভবন, খাদ্য ভবন, উপজেলা ভূমি অফিস ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনের সামনে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। জেলা আওয়ামী লীগ অফিস এলাকায় ৩০টি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধরা।
এ ছাড়া আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জয়পুরহাটে গুলিতে দু’জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন– মেহেদী হাসান ও আব্দুর রহিম। তাদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত আব্দুর রহিম আওয়ামী লীগ কর্মী। আক্কেলপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতকার্মী ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে ১৩ জন আহত হয়েছেন। উপজেলা পরিষদের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করেছে বিক্ষুদ্ধরা। আগুন দেওয়া হয়েছে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পাঁচটি মোটরসাইকেলে।
কক্সবাজারে অজ্ঞাতপরিচয় একজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গুলিবিদ্ধ একজনের লাশ রয়েছে। সংঘর্ষে কুড়িগ্রাম রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এখানে মারা গেছেন অজ্ঞাতপরিচয় একজন ও আহত হয়েছেন অর্ধশত। আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন ও জেলা পরিষদ ভাঙচুর করা হয়। হবিগঞ্জে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দফায় দফায় সংঘর্ষে একজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সদর উপজেলার রিচি গ্রামের রতন শীলের ছেলে রিপন শীল (২৭)। এদিকে মাধবপুর উপজেলায় পুলিশের পিকআপ ভ্যান, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের বাংলোতে অগ্নিসংযোগ এবং প্রেস ক্লাব ভাঙচুর করা হয়েছে।
ঢাকার ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে আসা হয় দুই যুবককে। তাদের মধ্যে বিপ্লবকে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। অন্যজন মারা গেছেন। তাঁর নাম-পরিচয় জানা যায়নি। সাভার ও আশুলিয়ায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। আর ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলায় মোহাম্মদ ইসতি নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হয়েছেন। তিনি কালিন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ও কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল জাহান রিপনের আপন ভাগনে বলে জানা গেছে।
খুলনায় এমপি হেলালের বাড়িতে আগুন
খুলনায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়, সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিনের বাড়ি, খুলনা প্রেস ক্লাবসহ বেশ কয়েকটি স্থানে অগ্নিসংযোগ করেছে আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়া খুলনা সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেকের বাড়ি, নগর ভবন, জেলা পরিষদ, নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের কার্যালয়সহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়। বিকেলে ভাঙচুর হয়েছে খালিশপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের বাড়ি, খালিশপুর থানা বিএনপি ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির কার্যালয়। আন্দোলনকারীর সঙ্গে সংঘর্ষে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতিসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন।
এদিকে দিনাজপুরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের দিনভর সংঘর্ষ হয়েছে। এতে গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। আহতদের মধ্যে ছয় সংবাদকর্মী রয়েছেন। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধরা শহরের মুন্সিপাড়া এলাকায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, তাঁর ভাই জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় পুলিশের দুটি গাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়।
টাঙ্গাইলে এমপি তানভীর হাসান ছোট মনিরের বাসভবন, পেট্রোল পাম্প ও হাইওয়ে রেস্তোরাঁয় ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই হাইওয়ে থানায় ও কয়েকটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিস স্টেশনসহ পাঁচটি শিল্প প্রতিষ্ঠান, একটি ফিলিং স্টেশন এবং স্থানীয় এমপির ব্যক্তিগত সহকারীর কার্যালয় ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ নগরীর পন্ডিতপাড়ায় এলাকায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও ময়মনসিংহ-২ আসনের সংসদ সদস্য শরিফ আহমেদ শরীফের বাসায় ভাঙচুর করেছে আন্দোলনকারীরা।
জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে আগুন এবং মুক্তিযোদ্ধা ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়েছে। এসব ঘটনায় যুবলীগ নেতাসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। কক্সবাজারে সংঘর্ষের সময় ৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। রাতে জেলা বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর করেছে আওয়ামী লীগ।
এ ছাড়া ঢাকার দোহারে ২৬ জন এবং সিলেটের বিশ্বনাথে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ১০ জন আহত হয়েছেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীর দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছে। গাইবান্ধায় পুলিশ সুপারের কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভের সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে অন্তত ১০০ জন আহত হয়েছেন।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক প্রায় চার ঘণ্টা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। মানিকগঞ্জে আওয়ামী লীগ কার্যালয়, প্রেসক্লাব, বিএনপি অফিস, ট্রাফিক বক্স, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, উপজেলা পরিষদ, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন সাংবাদিক ও পুলিশসহ শতাধিক।
ফরিদপুর জেলা ও শহর আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। ভাঙচুর করা হয়েছে শহরের রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর মুর্যাল ও ভাঙ্গা মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ বক্স। বাগেরহাটে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এলাকায় থাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করেছে আন্দোলনকারীরা। রামপাল উপজেলার ফয়লা এলাকায় মিছিল থেকে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা।
চাঁদপুরে বেশ কয়েকটি গাড়ি পোড়ানোর পাশাপাশি সমাকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনির বাসার নিচে থাকা কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেছে আন্দোলনকারীরা। এসব ঘটনায় পুলিশ, সাংবাদিকসহ অন্তত দুই শতাধিক আহত হয়েছেন।
নোয়াখালীর মাইজদী বাজার এলাকায় জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ইমন ভট্টের বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে আন্দোলনকারীরা। বেগমগঞ্জে স্থানীয় এমপি মামুনুর রশীদ কিরনের গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের ফ্যাক্টরি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় ও উপজেলা পরিষদে হামলা করা হয়। পিরোজপুরে আন্দোলনকারীদের মিছিল মহিলা কলেজ রোড দিয়ে পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার সময় সড়কের পাশে থাকা অন্তত ২০-২৫টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।
রাজশাহীর মোহনপুর থানা, সরকারি খাদ্যগুদাম, ভূমি অফিস ও আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে আন্দোলনকারীরা। মোহনপুর ইউএনও কার্যালয়েও ভাঙচুর চালানো হয়েছে।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন ব্যুরো, অফিস ও সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি)