বাংলাদেশের আলোচনায় জাহাঙ্গীরের মেয়র পদে থাকা না থাকা

বাংলাদেশের  আলোচনায় জাহাঙ্গীরের মেয়র পদে থাকা না থাকা
বাংলাদেশের  আলোচনায় জাহাঙ্গীরের মেয়র পদে থাকা না থাকা
সেলিনা  আক্তার:

আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে সাংসদ হওয়ার এবং সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা-অযোগ্যতা একই। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও সাংসদ হওয়ার যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, সাংসদ পদ হারানোর ক্ষেত্রে ওই সব যোগ্যতার কোনো একটি বা একাধিকের ব্যত্যয় হলে ব্যক্তি সাংসদ থাকতে পারবেন না বলে বলা হয়েছে। অর্থাৎ দলীয় পদ হারালে ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়ার পরও সংসদ সদস্য পদ হারাবেন।

কিন্তু স্থানীয় সরকার আইনে কেবল নির্বাচনে কোনো দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে ব্যক্তির দলীয় মনোনয়নের প্রয়োজন আছে। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর ব্যক্তি যদি দলে না থাকেন, তাহলে কী হবে সেটি বলা নেই।

তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাঁরা মেয়র জাহাঙ্গীরকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই বলতে পারেন তাঁরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। ব্যক্তি জাহাঙ্গীরকে নয়। সেখানে একটা মীমাংসার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এর সমাধান আইনিভাবে হওয়াটাই ভালো।

২০১৫ সালে সিটি করপোরেশন আইন সংশোধন করা হয় এবং দলীয় প্রতীকে মেয়র পদে নির্বাচনের বিষয়টি তাতে সংযুক্ত হয়। আইনের ৩২ ধারায় নতুন ৩২ক ধারা সন্নিবেশিত করা হয়। সেখানে বলা আছে, ‘কোনো সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হইবে।’ আইনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংজ্ঞাও নির্ধারণ করা হয়। বলা হয়, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী এইরূপ কোনো প্রার্থী, যিনি রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নপ্রাপ্ত নহেন।’

বিপত্তিটা এখানেই। কারণ, সংসদীয় পদ্ধতিতে দলীয় পদ চলে যাওয়ার পর প্রার্থী থাকার উপায় থাকে না। কিন্তু সিটি করপোরেশন আইনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে বিজয়ী ব্যক্তি দল থেকে বহিষ্কৃত হলে তাঁর পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই। আইনের এই অস্পষ্টতা একটি ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন আইনে দল থেকে বহিষ্কার হলে কী হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান নেই। আইনত তাঁর পদ ছেড়ে দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’

বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে ফয়সালা হতে পারে বলেও মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি আদালতের দ্বারস্থ হন, তবে মেয়র থাকার বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।’

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৫৭ ধারায় প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার বিষয়ে বলা আছে। সেখানে বলা আছে, যেকোনো সদস্য আওয়ামী লীগের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নিয়মাবলি, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে অংশ নিলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ তাঁর বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত কোনো সিটি মেয়রের দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম, এমনটাই জানান স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারের এমন কোনো আইন নেই যে তাঁকে মেয়র পদ হারাতে হবে।

জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে এটা করা হয় কারণ সাংসদের জন্য বিল পাস বিলম্ব হতে পারে বা সরকার পতন হতে পারে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের তো তা হতে পারে না।
তবে তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, ‘জাহাঙ্গীর আলমের বহিষ্কারের ঘটনার কারণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য। এটি আইনের লঙ্ঘন। তাই এই কারণে তাঁর পদ থেকে চলে যেতে হলেও সেটি আদালতের মাধ্যমে ঠিক হবে।’

স্থানীয় সরকার আইনের নানা ফাঁকেও জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কারের সুযোগ আছে বলেও মনে করেন তোফায়েল আহমেদ। যেমন নির্বাহী আদেশে মন্ত্রণালয় থেকে মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে নৈতিক স্খলন বা ফৌজদারি অপরাধ থাকতে হবে। জাহাঙ্গীর আলমের ক্ষেত্রে এর কোনোটিই খাটে না। তাই এখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাহী আদেশে বহিষ্কার করতে পারে। জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এমন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে তার ইঙ্গিত আজ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি আজকের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। আজকের সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছেও এ বিষয়ে জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন আইন)-এর ১২ ধারায় সিটি মেয়র বা কাউন্সিলরদের অপসারণের বিষয়টির কথা বলা আছে। সেখানে নৈতিক নানা স্খলনের কথা বলা আছে, যাতে মেয়রকে অপসারণ করা যায়। আর তা করা হলে তিন দিনের মধ্যে সিটি মেয়র, মেয়র প্যানেলের জ্যেষ্ঠ সদস্যের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন।

আইনের ১৪ ধারায় নির্বাচিত কাউন্সিলরদের দুই-তৃতীয়াংশের অনাস্থার কারণেও মেয়র অপসারিত হতে পারেন।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয় সরকার আইনের এত ফাঁকফোকর আছে যে সরকার চাইলে তাঁকে অপসারণ করতে পারে