ঢোল-করতাল, মঙ্গলশাঁখে বর্ণাঢ্য রথযাত্রায় মাতল ঢাকা   চট্টগ্রাম

ঢোল-করতাল, মঙ্গলশাঁখে বর্ণাঢ্য রথযাত্রায় মাতল ঢাকা   চট্টগ্রাম
ঢোল-করতাল, মঙ্গলশাঁখে বর্ণাঢ্য রথযাত্রায় মাতল ঢাকা   চট্টগ্রাম

ঢোল-করতাল, মঙ্গলশাঁখে বর্ণাঢ্য রথযাত্রায় মাতল ঢাকা   চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঢোল-করতাল বাদ্যের তালে তালে মঙ্গলশঙ্খ ও উলুধ্বনি দিয়ে নেচে-গেয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন লাখো ভক্ত। সুসজ্জিত রথে বসা ছিলেন শ্রী জগন্নাথ-সুভদ্রা ও বলভদ্র দেব। দড়ি টেনে সেই রথ এগিয়ে নেন ভক্তরা।

প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সনতান ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, রথের দড়ি ধরে যিনি টান দেন তার মনের সব ইচ্ছা পূরণ হয়, তিনি ভগবানের বিশেষ কৃপা লাভ করেন।

প্রতিবছরের মতো এবারও রোববার (৭ জুলাই) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীতে তিন মন্দির থেকে রথ বের হয়। প্রায় দু শ বছরের প্রাচীন তুলসীধাম মন্দির থেকে কেন্দ্রীয় রথযাত্রা কমিটির উদ্যোগে শোভাযাত্রা বের হয়। আন্তর্জাতিক শ্রীকৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) নগরীর প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দির ও নন্দনকানন রাধামাধব মন্দির-গৌরনিতাই আশ্রম থেকে আলাদাভাবে শোভাযাত্রা বের করে।

রথযাত্রা উপলক্ষে নগরীর নন্দনকানন এলাকায় সাজ সাজ রব দেখা যায়। সকাল থেকেই নগরী ও আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে ছোট-বড় রথ নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নিতে আসেন ভক্তরা।

বিকেল ৩টার দিকে তুলসীধামে মঙ্গলশঙ্খ ও উলুধ্বনি দিয়ে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলভদ্রের মূর্তি রথে তোলা হয়। এরপর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাইকমিশনার ডা. রাজীব রঞ্জন। অতিথিরা রথের রশি টেনে শোভাযাত্রার সূচনা করেন।

তুলসীধামের কেন্দ্রীয় রথের সঙ্গে মহাশোভাযাত্রায় শ্রীকৃষ্ণায়ন, মনোহরখালী, টেকপাড়া, সদরঘাট মাইজপাড়া, শাহাজীপাড়া, পার্বতী ফকিরপাড়া, কেদারনাথ তেওয়ারি কলোনি, টাইগারপাস জগন্নাথ সংঘ, সুপ্রভাত বয়েজ ক্লাব, গঙ্গাবাড়ী, পাথরঘাটা গিরিধারী মন্দির ও ইপিজেড শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরসহ অর্ধশতাধিক মঠ-মন্দিরের রথ অংশ নেয়।

তুলসীধামের সামনে থেকে নিউমার্কেট, কোতোয়ালি, লালদীঘির মোড় ঘুরে আন্দরকিল্লা, চেরাগি পাহাড় হয়ে প্রেসক্লাব ঘুরে লাভলেইন সড়ক দিয়ে নন্দনকানন রথের পুকুর পাড় পৌঁছালে শোভাযাত্রার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

শোভাযাত্রা শুরুর আগে উদ্বোধনী আয়োজনে চট্টগ্রাম সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, ভারতের সহকারী হাইকমিশনার ডা. রাজীব রঞ্জন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ, সিএমপি কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম, চসিকের কাউন্সিলর আব্দুস সবুর লিটন, জহরলাল হাজারী ও রুমকি সেনগুপ্ত, কেন্দ্রীয় রথযাত্রা উদযাপন কমিটির সভাপতি মাধব চন্দ্র চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক বিধান ধর, তুলসীধাম পরিচালনা পরিষদের সম্পাদক স্থপতি প্রণত মিত্র চৌধুরীসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।

ইসকন রাধামাধব মন্দির-গৌরনিতাই আশ্রমের পক্ষ থেকে নগরীর ডিসি হিলের সামনে থেকে রথযাত্রা বের হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এর উদ্বোধন করেন। এ সময় সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, নন্দনকানন ইসকন রাধামাধব মন্দির-গৌরনিতাই সেবাশ্রমের সাধারণ সম্পাদক তারণনিত্যানন্দ দাস, সহসভাপতি অকিঞ্চন গৌর দাস, যুগ্ম সম্পাদক মুকুন্দ ভক্তি দাস ও সদস্য অপূর্ব মনোহর দাস ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বিকেল ৫টায় শুরু হওয়া রথযাত্রা ডিসি হিলের সামনে থেকে সিনেমা প্যালেস, আন্দরকিল্লা, চেরাগি পাহাড় হয়ে আবারও নন্দনকাননে গিয়ে শেষ হয়।

এদিকে রথযাত্রার সবচেয়ে বড় আয়োজন হয়েছে নগরীর প্রবর্তক মোড়ে। ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের উদ্যোগে এ রথপরিক্রমার শোভাযাত্রায় লাখ মানুষের ঢল নামে। বিকেল ৫টায় শোভাযাত্রা প্রবর্তক মোড় থেকে শুরু হয়ে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সিনেমা প্যালেস মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। এতে ১৭০টিরও বেশি ধর্মীয় সংগঠন এবং বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা যোগ দেন।

নগরীর মোড়ে মোড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা রথযাত্রায় অংশ নিয়ে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, মঙ্গলপ্রদীপ পূজার নৈবদ্য সহকারে জগন্নাথ-বলদেব-সুভদ্রাকে অভ্যর্থনা জানান। ঢোলের বাজনার সঙ্গে শোভাযাত্রায় বিভিন্ন পৌরাণিক সাজের মাধ্যমে আবহমান বাংলা ও পৌরাণিক বিভিন্ন চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয় উৎসবে।

রোববার বিকেল ৪টার দিকে উদ্বোধনী আয়োজনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবার মিলিত রক্তস্রোতের বিনিময়ে এবং আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে জন্মলাভ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সেই চেতনা ধারণ করে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে ধর্মান্ধরা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত করার চেষ্টা করে।’

‘আমাদের সরকার সবসময় এ অপশক্তিকে দমন করেছে। যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে তাদের রুখে দিয়েছে। অনুরোধ করব, আপনারা এ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ছড়িয়ে দেবেন এবং যে চেতনা ধারণ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সে চেতনা আমরা সবসময় বুকে ধারণ করে এগিয়ে চলব,’— বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌরদাসের সভাপতিত্বে ও সাংবাদিক বিপ্লব পার্থের সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, শিক্ষাবিদ জীনবোধি ভিক্ষু, পুণ্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস, জগন্নাথ দাস, জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক চন্দন তালুকদার, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ নেতা নিতাই প্রসাদ ঘোষ, মহানগর পূজা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন উজ্জ্বল, নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবু।

আগামী ১৬ জুলাই উলটো রথযাত্রার মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এ উৎসব শেষ হবে।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর